আবরার হত্যার পরও ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বন্ধ হয়নি মারধর-নির্যাতন

জাতীয়

‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’…. লেখা মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সেই আকিবের কথা মনে আছে? গত ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয় আকিব। চলতি মাসের শুরুর দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভেতরে নাড়া দেয় সব নেটিজেনদের।

মা-বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে মেডিকেলে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন মাহাদী জে আকিবকে। কিন্তু নিজের ডাক্তারি পড়া দূরে থাক, টানা ১৯ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছে সে। কিন্তু সবাই আকিবের মতো ফিরতে পারে না, যেমনটা পারেনি বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ।
দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী পিঠিয়ে হত্যা করে। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েটসহ পুরো দেশ। এরপর ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।

দুইবছর পর এ মামলায় দুই পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক রায়ের জন্য ২৮ নভেম্বর তারিখ রেখেছিলেন। তবে আজ রবিবার (২৮ নভেম্বর) এই মামলার রায় পিছিয়ে দিয়েছে আদালত। আগামী ৮ ডিসেম্বর দেওয়া হবে এ মামলার রায়। মামলায় অভিযুক্ত ২৫ আসামির সবাই বুয়েটের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড কিংবা চমেকের আকিবের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া— সময়ের ব্যবধানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু তাতে টনক নড়ে না ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কারও। আবরার হত্যার দুই বছর পরে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এখনও বন্ধ হয়নি মারধর-নির্যাতন।

রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নীতি-আদর্শ থেকে দূরে সরে প্রতিনিয়ত জড়াচ্ছে চাঁদাবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন সহিংস কার্যকলাপে। আর তথাকথিত এই ছাত্র রাজনীতির বলি হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে একের পর এক শিক্ষার্থীকে।

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যখন-তখন মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফেসবুকে পোস্ট দেয়া, ছাত্রনেতাদের সালাম না দেওয়া- এমন সব ঠুনকো অজুহাতে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

করোনা মহামারি কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত অক্টোবরে খুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল। তারপর দুমাস না পেরোতেই অন্তত ৪টি হলে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর অভিযোগ সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব অভিযোগের সুরাহা না করে বরং এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই দাবি করছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ না করে সব সময় নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর প্রশাসনের আশকারা পেয়ে তাদের আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের উচিত ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের সহিংস কাজের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সবাই জানে ছাত্রলীগ একটি খুনি সংগঠন। আমরা আজ এই হত্যাকাণ্ডের রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তবে রায় পিছিয়ে দিয়েছে। সবার প্রত্যাশা থাকবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যথাযথ পাবে। আরও ছাত্রলীগও সেখান থেকে শিক্ষা নেবে। আর যদি তাদের (ছাত্রলীগ) বাঁচানো কোন রায় হয় তাহলে তা কেউ মেনে নেবেন না।

তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রলীগের মারধর-নির্যাতনে জন্য যতটা না তারা (ছাত্রলীগ) দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী ভিসি-প্রক্টর ও প্রভোস্ট। এখানে ভর্তিতে মেধাতালিকা হয়, সে অনুযায়ীতো হলে হলে সিট বন্ধন করা যায়। কিন্তু প্রশাসন তা করেন না।

“ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সংস্কৃতি বজায় রাখতে পরিবেশ পরিষদ আছে। সেখানে উন্মুক্তভাবে সব ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আলোচনা হোক। আমরা ছাত্রদল সবার আগে প্রশাসনকে সহায়তা করবো।”

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগের সম্পর্ক আদর্শিক। এখানে শিক্ষার্থীদের সাথে সুযোগ-সুবিধা, সংকট এসব বিষয় নিয়ে তারা কথা বলবে। শিক্ষার্থীরা যাতে মানবসম্পদে পরিণত হয় এ জন্য তারা মতবিনিময় করবে। এটাই আমাদের আবাসিক হলের সাংগঠনিক কাঠামো।

গেস্টরুমে নির্যাতন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন ধরনের নেতিবাচক ঘটনা যদি কেউ ঘটায় যা আমাদের সংগঠনের জন্য নেতিবাচক ধারণা নিয়ে আসে, তাহলে আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন,  আমরা এটা সবাই জানি যে বুয়েটের আবরার হত্যার সাথে সরাসরি ছাত্রলীগ জড়িত এবং এটি একটি রাজনৈতিক হত্যা।

তিনি বলেন, দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বর্তমানে কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই৷ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হয় কতিপয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কারণে। ছাত্রলীগ ছাড়াও সব ক্যাম্পাসে অনেক ছাত্রসংগঠন রয়েছে। যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকে, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এসকল সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও উচিত ক্যাম্পসের সকল সন্ত্রাসবাদ সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা, আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ঘৃণা করা। আর ক্যাম্পাসে রাজনীতির চচা থাকবে। কিন্তু রাজনীতিটা হতে হবে সন্ত্রাস ও দম্ভ মুক্ত। যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসাইন বলেন, আমরা হলে হলে গেস্টরুম-গণরুম কালচারের বিরুদ্ধে বলে আসছি অনেক আগে থেকেই। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটা বন্ধ করতে পারেনি, তাদের আশকারায় বেপরোয়া ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন।

তিনি আরও বলেন, আইন করে গণরুম ও গেস্টরুম কালচার বন্ধ করতে হবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতন বিরোধী একটি আইন পাশ করতে হবে। আমরা মনে করি নির্যাতন বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

গণরুম বন্ধের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদক্ষেপ কি এই প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, এটা অনেক দিন ধরে চলে আসা কালচার। আমরা এই গণরুমকে সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়ার জন্য কাজ করছি। শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন গণরুমে সরাসরি না উঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সিট চায়।

হলে হলে পলিটিক্যালভাবে শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম নির্যাতন করা হয় এ ব্যাপারে প্রশাসনের পদক্ষেপ কি— জানতে চাইলে তিনি বলেন, গেস্টরুম কারও সাংগঠনিক কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। এটা রাখা হয়েছে অভিভাবকদের বসার জন্য। মূলত এটা সৌজন্য কাজে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এসব নিয়ে যখন নিউজ হয় তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা চেষ্টা করি সেগুলো থেকে দূরে সরে আসার জন্য।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *