বাংলাদেশের প্রযুক্তি জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক এখন বাংলাদেশে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মালিকানাধীন SpaceX-এর এই উদ্যোগটি গ্রহব্যাপী উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফলভাবে সেবা দিয়ে আসা স্টারলিংক এবার পা রাখল দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই প্রযুক্তি কি শুধু এক আকর্ষণীয় সুযোগ। নাকি এটি সত্যিই দেশের ডিজিটাল বিপ্লবকে গতিশীল করবে?
প্রাথমিক যাত্রা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্টারলিংকের প্রযুক্তি পরীক্ষা চালানো হয়। এরপর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পর বিষয়টি আরো ত্বরান্বিত হয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ইলন মাস্কের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সে এই প্রকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। ফলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২৯ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্টারলিংককে বিনিয়োগ নিবন্ধন দেয় এবং ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেয়। পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ইতোমধ্যে ঢাকায় কয়েকবার পরিচালিত হয়েছে। সর্বশেষ, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে স্টারলিংকের মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
স্টারলিংক কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে
স্টারলিংক মূলত লো-আর্থ-অরবিট (LEO) স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর তুলনামূলক কাছাকাছি কক্ষপথে ঘোরে। ফলে অন্যান্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার তুলনায় কম লেটেন্সি এবং অধিক গতি প্রদান সম্ভব হয়। স্থলভিত্তিক অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের বাইরে গিয়েও স্টারলিংক এমন সব এলাকায় ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম। যেখানে ফাইবার বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না। এ প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের সম্ভাব্য সেবার মান পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ডাউনলোড গতি ১০০ থেকে ২৩০ এমবিপিএস পর্যন্ত পৌঁছায় এবং লেটেন্সি মাত্র ৩০ মিলি সেকেন্ডের আশপাশে থাকে, যা ভিডিও কনফারেন্সিং, অনলাইন ক্লাস, রিমোট ওয়ার্কিং বা গেমিংয়ের জন্য যথেষ্ট কার্যকর।
স্টারলিংকের সামনে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে স্টারলিংকের সম্ভাব্য সেবামূল্য নিয়ে শুরু থেকেই নানা আলোচনা চলছে। এই সেবাটি গ্রহণের জন্য ব্যবহারকারীদের প্রাথমিকভাবে একটি স্টারলিংক কিট কিনতে হবে, যার দাম ৩৪৯ থেকে ৫৯৯ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা। এরপর মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি গড়ে ১২,০০০ থেকে ১৭,০০০ টাকার মধ্যে। এই ব্যয়মান শহরাঞ্চলের সাধারণ ব্যবহারকারীদের নাগালের বাইরে। বর্তমানে দেশে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড সেবা মাত্র ৫০০ থেকে ১,২০০ টাকায় ৫-২০ এমবিপিএস গতির সংযোগ দেয়। এ ছাড়া সম্প্রতি বিএসসিএল ব্যান্ডউইথের দাম ১০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, যা স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতাদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে।
তাই প্রশ্ন উঠছে, এত উচ্চমূল্যের সেবা কি বাংলাদেশের বাজারে টিকে থাকতে পারবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘরোয়া বা সাধারণ গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক আপাতত সাশ্রয়ী নয়। তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আইটি কোম্পানি, রিমোট গবেষণা কেন্দ্র, সামুদ্রিক যোগাযোগ, দুর্গম অঞ্চলের হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জরুরি সেবা সংস্থার জন্য এটি হতে পারে অত্যন্ত কার্যকর একটি সমাধান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে স্টারলিংক মালয়েশিয়ার গেটওয়ে ব্যবহার করে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক সেবা দিচ্ছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে পুরোপুরি চালু হতে হলে বিটিআরসির অনুমোদন প্রয়োজন এবং একটি গ্রাউন্ড গেটওয়ে স্টেশন স্থাপন বাধ্যতামূলক। এ লক্ষ্যে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কারিগরি সহায়তায় কাজ শুরু করেছে।
কারিগরি সক্ষমতা ও গতি
ঢাকায় পরীক্ষামূলক ব্যবহারে স্টারলিংকের ইন্টারনেট গতি ১০০-২৩০ এমবিপিএসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে এই গতি ব্যবহারকারীর সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল। একাধিক স্টারলিংক টার্মিনাল একই সঙ্গে ২৫০ ব্যবহারকারীকে সেবা দিতে সক্ষম হলেও আদর্শ সংখ্যা ৫০ জনের নিচে। ব্যান্ডউইথের লোডের কারণে গতি কমে যেতে পারে। বিশেষ করে উন্মুক্ত সেবা এলাকায়।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
স্টারলিংক ইতোমধ্যে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক অঞ্চলে কার্যকরভাবে সেবা দিচ্ছে। আফ্রিকার কিছু দেশে মাত্র ১০-৩০ ডলারে সেবা চালু করে তারা গ্রাহক বৃদ্ধি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশেও যদি শুরুতে কমমূল্যে এই সেবা চালু করা হয়। তবে স্টারলিংক অনেক ব্যবহারকারীর আস্থা অর্জন করতে পারবে।
লাইসেন্স ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো
বাংলাদেশে স্টারলিংক কার্যক্রম চালুর জন্য ২০২৫ সালের ২৯ মার্চ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিনিয়োগ নিবন্ধন প্রদান করে। এর মাধ্যমে স্টারলিংক ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে সেবা চালু করতে হলে বিটিআরসির কাছ থেকে এনজিএসও (NGSO—Non-Geostationary Satellite Orbit) লাইসেন্স পেতে হবে। এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
বর্তমানে স্টারলিংক মালয়েশিয়াভিত্তিক গেটওয়ে স্টেশন ব্যবহার করে বাংলাদেশে সেবা দিচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় গেটওয়ে স্থাপন অপরিহার্য হয়ে পড়বে, যা দেশের ভেতরেই কম সময়ের মধ্যে ডাটা স্থানান্তর নিশ্চিত করবে এবং সেবার মান আরো বাড়াবে।
শেয়ার করুন