ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে সৃষ্ট ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসের শাসনের অবসানের দুই বছর আগে পর নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে ভোট দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
শনিবার ভোর থেকেই ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে শ্রীলংকায়।
স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর গণনা শুরু হবে। তবে রোববার সকালের আগে ফলাফল পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে বিবিসি।
এই নির্বাচনকে দেশটির ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সংস্কারের নির্ধারক হিসেবে দেখা হলেও কর বৃদ্ধি, ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার কারণে অনেকে এখনও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
২০২২ সালে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলংকার সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। পরে তিনি পদত্যাগ করলে দায়িত্ব নেন ৭৫ বছর বয়সী বিক্রমাসিংহে।
ভারতের থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহযোগী ফেলো সৌম্য ভৌমিক বিবিসিকে বলেন, “ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, আকাশচুম্বী ব্যয় এবং দারিদ্র্য দেশটির ভোটারদের দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করতে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সমাধান খুঁজতে মরিয়া করে তুলেছে।
“দেশটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এই নির্বাচন শ্রীলঙ্কার পুনরুদ্ধারের পথ গঠন এবং এর সরকারের প্রতি দেশে-বিদেশে আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।”
তবে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনার দায়িত্বে থাকা প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে আরেক মেয়াদ দায়িত্বে থাকতে চাইছেন।
গোতাবায়া ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার এক সপ্তাহ পর পার্লামেন্ট ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিককে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়।
রাজস্ব আয় বাড়ায় না এমন অনুৎপাদনশীল প্রকল্পগুলোতে অত্যধিক ঋণ গ্রহণের ফলে দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। এছাড়া কোভিড মহামারীর প্রভাব এবং স্থানীয় মুদ্রাকে চাঙ্গা করতে বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবহার করার জন্য সরকারের জেদ অর্থনীতির দ্রুত পতনে ভূমিকা রেখেছিল।
তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ওষুধ, খাদ্য, রান্নার গ্যাস এবং জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয় দেশটিতে। সে সময় লঙ্কানদেরকে নিত্যপষ্যের জন্য দিনের পর দিন লাইনে অপেক্ষাও করতে হয়েছে।
এক পর্যায়ে দেশটিতে জনবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবন, তার কার্যালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো দখল করে নেয়। এর ফলে তখনকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এরপর দেশের হাল ধরা প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংকটপূর্ণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠোর শর্ত মানতেও রাজি হয়। ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের জন্য দ্বিগুণ কর বৃদ্ধি, বিদ্যুতে ভর্তুকি বাতিলসহ নানা রকম কৃচ্ছ্রতা কর্মসূচি গ্রহণ করেন বিক্রমাসিংহে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। বিক্রমাসিংহে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী করতেও সফল হন।
তবে এতো কিছুর পরও লড়াই করতে হচ্ছে দেশটির মানুষকে।
৩২ বছর বয়সী ইয়েশান জয়ালাথ বলেন, “চাকরি খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে কঠিন বিষয়। অ্যাকাউন্টিং ডিগ্রি নিয়েও আমি স্থায়ী চাকরি পাচ্ছি না।”
২০২২ সালে কলম্বোর উত্তরে নিজের টালির কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়া নরবেট ফার্নান্দো বিবিসিকে বলেন, মাটি, কাঠ ও কেরোসিনের মতো কাঁচামালের দাম দুই বছর আগের তুলনায় এখন তিনগুণ বেশি। খুব কম লোকই বাড়ি তৈরি করছে বা ছাদের টাইলস কিনছে।
“৩৫ বছর পর আমার কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দেখে কষ্ট হচ্ছে। ২০২২ সালের পর এই এলাকার ৮০০ কারখানার মধ্যে মাত্র ৪২টি কারখানা চালু আছে।”
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে অর্থনীতির অবস্থা হতাশাজনক হলেও ২০২৪ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে এখনও পুরোপুরি সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) শ্রীলঙ্কা বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অ্যালান কিনান বিবিসিকে বলেন, “শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি হয়তো আপাতত তার পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে, কিন্তু তারপরও জনগণকে বুঝতে হবে যে, তাদরকে এখনও অনেক মূল্য দিতে হবে।”
কঠিন সময়ে দেশের হাল ধরতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামা পাঁচ প্রার্থী আছেন আলোচনায়। তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে আছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।
যদিও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই ভোটের আগে তিনি দুইবার নির্বাচনে অংশ নিয়েও জিততে পারেননি।
আরেক প্রার্থী বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পার্টি জোটের অনুরা কুমারা দেশানায়েক দুর্নীতিবিরোধী কঠোর পদক্ষেপ এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শক্ত অবস্থানে আছেন বিরোধী দল ‘সামাগি জন বালাওয়েগার’ (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসাও। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসর ছেলে। রানাসিঙ্গে ১৯৯৩ সালে গৃহযুদ্ধের সময় আততায়ীর হাতে নিহত হন। সাজিথ প্রেমাদাসা এই নির্বাচনে বেশ ভালো করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজপাকসে পরিবার থেকেও প্রার্থী হয়েছেন একজন। তার নাম নমল রাজাপাকসে। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে।
নমল লড়ছেন শ্রীলংকান পদুজন পেরামুনা (এসএলপিপি) দল থেকে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা তার আরেক চাচা বাসিল রাজাপাকসে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, একজন ভোটার তিন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি ভোট পেলে তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
আর কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট হবে। দ্বিতীয় দফা ভোটে যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই হবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।