ছাত্রলীগের জয়-লেখক: অপকর্মের ফিরিস্তি যাচ্ছে শেখ হাসিনার হাতে

রাজনীতি

ছাত্রলীগ সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক সময়ের নানা কর্মকাণ্ডে সংক্ষুব্ধ ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির বড় একটি অংশ। এসব নিয়ে নেতারা পুড়ছেন মনস্তাপে। এই প্রেক্ষাপটে জয় ও লেখকের নামে নালিশ যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ছাত্রলীগের শীর্ষ এ দুই নেতার অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে শতাধিক নেতার সই করা লিখিত অভিযোগপত্রটি আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে পাঠানো হবে।

এ লক্ষ্যে অভিযোগপত্রে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রীয় নেতার সই নেওয়ার কাজ আজ শুক্রবারের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছেন নেতারা। কাল শনিবার গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে সিলগালা করা অভিযোগপত্রটি আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে দপ্তর সম্পাদকের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে।

এদিকে সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় দাবি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে স্বেচ্ছায় তিনি পদ ছাড়বেন। তবে এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সোহান খান বলেন, ‘এ দুইজনের বিরুদ্ধে রয়েছে পাহাড়সম অভিযোগ। তবে দলীয় প্রধানের কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়াটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আমি সরাসরি কিছু বলতে পারব না।’

শতাধিক নেতা অভিযোগপত্রে সই করবেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শতাধিক নয়, সবাই-ই তাঁদের ওপর অসন্তুষ্ট। এই কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ। তাঁরা যেভাবে প্রেস কমিটি দিচ্ছেন, সেটা সংগঠনের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসের খেয়ানত করছেন। এ ক্ষেত্রে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

সহসভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ বলেন, জয়-লেখকের বিভিন্ন অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আশা করছি, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নেতা অভিযোগপত্রে সই করবেন।

অভিযোগপত্রে সই নেওয়ার কাজের সমন্বয় করছেন সংগঠনের সহসভাপতি কামাল খান। কী কী অভিযোগ করা হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনই জানাতে চাচ্ছি না। তবে জয়-লেখকের বিভিন্ন অসাংগঠনিক ও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ড অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হবে।’

অভিযোগপত্রে নেতাদের সইয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সই নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক নেতার সই সংগ্রহ করতে পেরেছি।’

অভিযোগপত্রে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেটি জানানো না হলেও এর একটি খসড়া পাওয়া গেছে। এতে স্বেচ্ছাচারিতা, কেন্দ্রীয় নেতাদের অবমূল্যায়ন, পদ-বাণিজ্য, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে অযৌক্তিকভাবে কমিটির কলেবর বাড়ানো, বিবাহিত-চাঁদাবাজ-মাদকসেবী-ছাত্রদল ও শিবিরকর্মীদের কমিটিতে ঢুকানো, মেয়াদ শেষ হলেও পদ আঁকড়ে থাকাসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।

জয়-লেখক ভারমুক্ত হলেও ঝামেলামুক্ত হয়নি ছাত্রলীগ>>

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরপত্র ঘিরে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সংগঠনের ওই সময়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরে ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দুই শীর্ষ নেতাকে ‘ভারমুক্ত’ করে পূর্ণ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হওয়ার পর তাঁরা বিলাসী জীবনযাপন শুরু করেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ভারমুক্ত হওয়ার এক মাস পর হল ছেড়ে তাঁরা রাজধানীতে দুটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে থাকা শুরু করেন, যার মাসিক ভাড়া ৬০ হাজার টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া তাঁদের একাধিক গাড়ি ব্যবহার করারও অভিযোগ রয়েছে। জয়ের অনুসারী এক নেতা জানান, জয় রাজধানীর নিউমার্কেটে অবস্থিত বিশ্বাস বিল্ডার্স ভবনের ছয় তলায় থাকেন। অন্যদিকে, লেখক থাকেন ইস্কাটন গার্ডেন সিটি ভবনের ১০ তলায়।

নেতারা অভিযোগ করেন, জয়-লেখক ভারমুক্ত হলেও ঝামেলামুক্ত হয়নি ছাত্রলীগ। উল্টো এ দুই নেতার কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ নতুন করে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে।

ছাত্রলীগের সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই জয়-লেখক সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। সাংগঠনিক কাজে তাঁরা অন্য নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করেন না। তাঁদের কিছু কাছের লোক সব ধরনের অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালায়। এ নিয়ে সংগঠনের ভেতরে এক সময় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১১ ধারার (খ)-তে বলা আছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে। (গ)-তে বলা হয়েছে, বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল তিন মাস বাড়ানো যাবে। সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্যরা যোগ দেবেন। সে হিসেবে কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনও সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেননি এ দুই নেতা। এমনকি কমিটির মেয়াদ বাড়াতে ডাকেননি বর্ধিত কমিটির সভাও।

এ ছাড়া ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ ধারার (ঙ)-তে বলা আছে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা বসবে। অন্য সব নিম্নতম শাখায় নির্বাহী সংসদের সভা বসবে প্রতি মাসে অন্তত একবার। এ হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী জয়-লেখক কমিটির দুই বছরে দুই মাস পরপর যেখানে ১২টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র ১টি। নেতাদের অভিযোগ, ইউনিটগুলোর সম্মেলন ও দলীয় সব কর্মসূচির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় নেওয়ার কথা। তবে এসব সিদ্ধান্ত জয়-লেখক নেন একা একাই।

সম্মেলন ছাড়াই ৩৩ কমিটি>>

গত ৩১ জুলাই রাতে অর্থাৎ শোকের মাস আগস্টের প্রথম প্রহরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটির কলেবর বাড়ানো হয়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০টির মতো শূন্য পদ থাকলেও এর বিপরীতে বর্ধিত কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে কয়েক গুণ নেতাকে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগস্টের প্রথম প্রহর থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বর্ধিত কমিটিতে পদ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়, যা চলে তিন দিন। নামের জায়গা ফাঁকা রেখে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেওয়ার চিঠি ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ৩০০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও, এভাবে গণহারে পদ বিতরণের কারণে কমিটির সদস্য সংখ্যা কত, সেটি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও জানেন না। যদিও ছাত্রলীগের দপ্তর সেল থেকে বলা হয়, পদায়ন করা হয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

ছাত্রলীগের অধিকাংশ জেলা কমিটির সম্মেলন সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জয়-লেখকের সই করা বিভিন্ন কমিটির অনুমোদন দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং কমিটি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, জয়-লেখক দায়িত্ব পাওয়ার পর জেলা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৮টি কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সম্মেলন ছাড়াই কমিটি দেওয়া হয়েছে ৩৩টিতে। বাকি কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে হলেও সম্মেলনস্থল থেকে মাত্র তিনটি কমিটি দেওয়া হয়। বাকি কমিটিগুলো সম্মেলনের কয়েক দিন পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।

সম্মেলন করলেও কিছু ইউনিটে জেলা আওয়ামী লীগের মতকে উপেক্ষা করে দুর্বল নেতৃত্ব বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আট বছর পর গত ১৭ জুলাই বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন শহরের সিরাজ উদ্দীন টাউন হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। পরে ২৪ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির অনুমোদন দেন। রেজাউল কবিরকে সভাপতি, তৌশিকুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকসহ ৩৩ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকেই সদ্য ঘোষিত এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বরগুনা শহরে পদবঞ্চিতরা মাঠে নামেন। তাঁরা মূলত বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার অনুসারী। এর পর শোক দিবসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদে গত ১৬ আগস্ট একটি সমাবেশে ছাত্রলীগ কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে জেলা আওয়ামী লীগ।

অভিযোগ প্রমাণ হলে অব্যাহতি নেবেন জয়>>

কেন্দ্রীয় নেতাদের এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, অভিযোগ থাকতেই পারে। তবে এসবের সত্যতা থাকতে হবে। পদবাণিজ্যসহ যেসব অভিযোগ রয়েছে, এগুলো যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে পদ থেকে অব্যাহতি নেব।

তবে লেখক ভট্টাচার্যের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

 

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *