
আগামী ১৯ জুলাই রাজধানীতে ‘জাতীয় সমাবেশ’ করবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। ওইদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। ৭ দফা দাবিতে সমাবেশে লাখো নেতাকর্মী ও সমর্থক হাজির করার টার্গেট নিয়েছে জামায়াত। ইতোমধ্যে বিএনপিসহ বাম-ডান-ইসলামপন্থি ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করবে জামায়াত। সে লক্ষ্যে ইসলামি দলগুলোকে পাশে চায় দলটি। একইসঙ্গে ইসলামিক ভোটগুলোকে একবাক্সে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন নেতারা। এছাড়া অমুসলিমদের ভোটকেও গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত। বিগত সময়ে জামায়াত কোণঠাসা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লাসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনও ফিরে পেয়েছে। এখন আগামী নির্বাচনে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শনের পালা। এই সমাবেশ থেকে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান, দৃশ্যমান বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং নিবন্ধিত- অনিবন্ধিত ইসলামি দলগুলোকে এক কাতারে আনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর এ সমাবেশ হবে জামায়াতের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। এ কর্মসূচি ঘিরে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। কেউ কেউ এটিকে নির্বাচনপূর্ব একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখছেন। যেখানে একটি বৃহৎ জনসমর্থনের ভিত্তিতে প্রভাব তৈরির চেষ্টা করছে দলটি। যদিও জামায়াত বলছে, ৭ দফার দাবিতে শুধু তাদের দলের নয়, বরং এ সমাবেশ হবে দেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও ন্যায্যতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। নেতারা জানান, জাতীয় সমাবেশ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ। ব্যাপক জনসমাগম ও শোডাউনের মধ্য দিয়েই দেশবাসীকে নির্বাচনি বার্তা দেওয়া হবে।
৭ দফা দাবির মধ্যে আছে-সব গণহত্যার বিচার; প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার; জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন; জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন; পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান; প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ।
জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সাত দফা দাবি সামনে রেখে আমাদের জাতীয় সমাবেশ। ১৯ জুলাই দুপুর ২টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে সমাবেশের কার্যক্রম। ইতোমধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারকে আহ্বায়ক করে একটা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি উপকমিটিও হয়েছে। সবগুলো কমিটি প্রস্তুতি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। এখন পর্যন্ত (৮ জুলাই) বাস্তবায়ন কমিটি ৫টি মিটিং করেছে। সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কাজ চলছে। জাতীয় সমাবেশ মূলত নির্বাচনকে ঘিরেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারাই ছিলেন তাদেরকে সমাবেশে দাওয়াত দেওয়া হবে।’
এদিকে জাতীয় সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে প্রচার কার্যক্রম, গণসংযোগ ও জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জনশক্তি ও সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে কাজ করছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশের জেলা ও মহানগর থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী নিশ্চিত করতে দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। এছাড়া সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ১৯ জুলাই সকালের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে দলটি। সে ধারাবাহিকতায় মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গণসংযোগ করছেন নেতারা। সমাবেশ সফলে দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরেরও ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
রোববার রাজধানীতে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হলে তাদের আপত্তি নেই। তবে যেনতেন একটি নির্বাচন তারা চান না। পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, যেমন আমরা ট্র্যাডিশনাল (প্রচলিত) নির্বাচনের বিপরীতে পিআর পদ্ধতি চাচ্ছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে চাচ্ছি, এটা আমাদের দলীয় এজেন্ডা, অন্যদেরও এজেন্ডা আছে।’
মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে ‘জাতীয় সমাবেশ’ বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে শফিকুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই-আগস্টের জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন এবং জীবন উৎসর্গকারী ছাত্র-জনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী এই সমাবেশের আয়োজন করেছে। জাতীয় সমাবেশ সর্বাত্মকভাবে সফল করার জন্য সংগঠনের সর্বস্তরের জনশক্তি ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
দলটির নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি প্রস্তুতি ততই বাড়ছে। জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনি প্রস্তুতিতে এগিয়ে রয়েছে। সারা দেশে আসনভিত্তিক একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা চতুর্মুখী তৎপরতায় ব্যস্ত সময় পার করছে। এদিকে সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিদর্শন করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জাতীয় সমাবেশের জন্য ৩১ ফুট প্রস্থ ও ৩৬ ফুট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট মঞ্চ থাকবে। প্যান্ডেলের ভেতরে এলইডি প্রজেক্টর এবং সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সিসি টিভির ব্যবস্থা থাকবে।
‘নির্বাচনি সমঝোতা’ নিয়ে আশাবাদী জামায়াত, তবে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে আছে বিভক্তিও : এদিকে ইসলামপন্থি দলগুলো নিয়ে ‘নির্বাচনি সমঝোতা’ করার চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। তবে এখন পর্যন্ত ‘ইসলামি দলগুলোর ঐক্য’ বলতে মোটাদাগে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য দল দুটি কখনো এক ছাতার নিচে আসেনি; বরং একধরনের দূরত্ব বজায় রেখেছে। সামনে তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়টি দৃশ্যমান হতে পারে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গত প্রায় সাড়ে চার দশকে ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রচেষ্টায় একটি বিষয় লক্ষণীয়। সব ইসলামি দলগুলোর মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ঐক্য হলেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ১৯৭৯ সালের পর অন্য কোনো ইসলামি দলই ঐক্য করতে আগ্রহী হয়নি। এর মূল কারণ ছিল জামায়েতের সঙ্গে অন্য ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মীয় কিছু বিষয়ে মতানৈক্য। ফলে এবার যে ঐক্য প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এসব বিষয়ের সমাধান না হলে আশু ঐক্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। জোটের কথা বললেও নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত এককভাবে প্রায় সব আসনে নিজেদের প্রার্থী প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দিয়ে রেখেছে। সে ক্ষেত্রে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট হলে দলটি তার শরিকদের কতটা ছাড় দেবে, তা আলোচনার বিষয়। অপরদিকে মতভেদের কারণে এতদিন দূরে রাখা বাকি ইসলামি দলগুলো জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব কতটা মানবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ফলে এসব বিষয় সামনে রেখে ঐক্য প্রচেষ্টা সফল হবে কি, হবে না-তা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরই পরিষ্কার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।