সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর বের হওয়া বিজয় মিছিলে শামিল হতে জাতীয় পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হয়েছিল টঙ্গীর সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সামিউ আমান নূর (১৩)। টঙ্গীর বৌ-বাজার এলাকায় বেড়ে ওঠা নম্র, ভদ্র ও মিষ্টিভাষী শিশু সামিউ হয়ত সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি স্বৈরাচারের পতনের পরও তাকে গুলিতে প্রাণ হারাতে হবে। পরিবারও বুঝে উঠতে পারেনি একমাত্র সন্তান সবাইকে কাঁদিয়ে এভাবে না পরপারে পাড়ি জমাবে।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিচারের দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকে নিহত শিশু সামিউ নূরের পরিবার।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সামিউ নূরের পরিবারের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের আলাপচারিতা হলে তারা জানান, দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সামিউ ছিল একমাত্র সন্তান। ছোট হওয়ায় খুব আদরের ছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী সময়ে জাতীয় পতাকা হাতে উত্তরা বিএনএস ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছিল সামিউ নূর। হঠাৎ তার মাথায় এসে গুলি লাগে। কোনোরকম চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার আগেই সে মারা যায়।
নিহত সামিউ নূরের বড় বোন আফরিন আমান বলেন, গত ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন, সারা দেশে তখন বিজয় উল্লাস চলছিল। এই বিজয় উল্লাসে শামিল হতে আমার ছোটভাই সামিউ জাতীয় পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর উত্তরা বিএনএস ফুটওভার ব্রিজে উঠে সে সাধারণ মানুষের বিজয়োল্লাস করার সময় হঠাৎ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। সাথে সাথে আমার ভাইটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, আমরা খবর পাওয়ার পর দ্রুত সেখান থেকে তাকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রাখেনি। সেখান থেকে বলা হয় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে দিন রাস্তায় জায়গায় জায়গায় হামলা-ভাঙচুরের কারণে আমার ভাইটাকে নিয়ে আর ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাতে পারিনি। একরকম বিনা চিকিৎসাতেই আমার ভাইটার মৃত্যু হয়েছে।
আফরিন আমান বলেন, আমরা ভাইটাকে নিয়ে উত্তরা থানাটাও অতিক্রম করতে পারিনি। আশপাশে যারাই ছিল, প্রত্যেকে বলেছে, এই গুলিটা দূর থেকে টার্গেট করেই করা হয়েছে। যে বা যারাই গুলি করেছে, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি করেছে। এমনটা কেন হবে? একটা স্বাধীন দেশে কেন ১৩ বছর বয়সী একটা শিশুকে এভাবে গুলি করা হবে? কেনই বা তাকে কোনোরকম বিনা চিকিৎসাতেই মারা যেতে হবে?
তিনি বলেন, আমার ভাইসহ সবগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই বলার নেই। এই হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত ছিল এবং যাদের নির্দেশনায় আমার শিশু ভাইসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনাসহ বড় বড় অভিযুক্তরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। আমরা এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। শুধুমাত্র এই অভিযুক্তদের ফাঁসি হলেই আমাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই শেখ হাসিনাসহ এই গণহত্যার সাথে জড়িত প্রত্যেক অভিযুক্তকে জনসম্মুখে এনে ফাঁসি দেওয়া হোক। আমার ভাইয়ের বিচার আমি নিজ চোখে দেখতে চাই।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিহতদের মধ্যে ১৮ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং প্রায় ৫১ শতাংশ নিহত ৩০ বছরের কম বয়সী তরুণ-যুবক। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
সংস্থাটির গবেষণা কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভিকটিমের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল ও জাতীয় দৈনিকগুলোর সূত্র থেকে আমরা ৮১৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে ৬৩০ জনের নাম জানা গেলেও ১৮৯ জনের নাম জানা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, আমরা গণমাধ্যম, হাসপাতাল ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যেসব বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাচ্ছি, তার উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে সহস্রাধিক হবে।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আসা ৮১৯ জনের মধ্যে ৪৭০ জনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। তাদের মধ্যে ১৮ বছরের কমবয়সী শিশু ৮৩ জন (১৮%), তরুণ ও যুবক বয়সী ২৪০ জন (৫১%), মধ্যবয়সী ১২৬ জন (২৭%) এবং বয়স্ক ব্যক্তি আছেন ২১ জন (৪.৫%)। আশঙ্কার বিষয় হলো, নিহতদের মধ্যে যাদের বয়স জানা গেছে, তাদের মধ্যে ৬৯ শতাংশেরই বয়স ৩০ এর কম।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এর আগে হাইকোর্ট ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করলে পুরো জুলাই মাসজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে থাকেন।
গত ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়। পরে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এমনকি পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপরও তারা দুই দফা হামলা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তী সময়ে হয়ে জোরদার হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন। একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এতে করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
শেয়ার করুন