
পিআর পদ্ধতিতে (ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব) নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আন্দোলনে সরব থাকলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ইসলামপন্থি দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দলের প্রার্থীরা দলীয় সবুজ সংকেত নিয়ে ইতোমধ্যে প্রচারও শুরু করেছেন।
‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে নিউইয়র্কে গত শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া এই ভাষণকে ইতোমধ্যে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা। ওই তিনটি দলের ছয় নেতা ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে এই তিন দলের ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বাধাও অনেকাংশে দূর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তার সরকার আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে নাগরিকবান্ধব সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারকে বিদায় করে বাংলাদেশ আবারও ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দেশে সংস্কারও চলছে, যাতে ভবিষ্যতের সরকারও এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণকে ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নেতারা বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরেছেন। বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের বার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের যে বার্তা প্রধান উপদেষ্টা দিলেন তার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য আরও সুদৃঢ় হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণ ‘যথেষ্ট শক্তিশালী’ ছিল। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এসব বিষয় বারবার উল্লেখ করছেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সন্দেহ নেই। আমরা নিশ্চিত যে নির্বাচন ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ হবে।”
ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় নিউইয়র্কে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সরকারের সংস্কার কর্মসূচি ও জাতীয় ঐক্য দুইই প্রতিফলিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নিঃসন্দেহে সেই উদ্দেশ্যের কথাই বলেছেন যার ভিত্তিতে তাদের সরকার গঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তারা এমন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে তাদের সেই দায়িত্ব দিয়েছিল।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দ্বিমত করার কোনো কারণ আমরা দেখি না। নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সবাই এর সঙ্গে একমত। আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইফ-বাট রাজনীতিতে নেই, আমরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে অংশ নেব।’
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময়সীমা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম যেগুলো আছে, সেগুলো যদি পরিপূর্ণভাবে শেষ করা হয় তাহলে আরও গোছালোভাবে নির্বাচনের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে। এর আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
জানা গেছে, জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোট, স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করাসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব চলছিল জামায়াত ও এনসিপির। এসব ইস্যুতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। এসব কর্মসূচিকে সমর্থন করেছে ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল। এ কারণে দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ফলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, সে প্রশ্নে তৈরি হয়েছিল একধরনের অনিশ্চয়তা।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে তিনটি দলের ছয় নেতা জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যান। পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনা হলো- তিন দলের দূরত্ব কমাতেই এই উদ্যোগ। কারণ এই মুহূর্তের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এ তিন দলের পূর্ণ সমর্থন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব কমানোর বিষয়ে আমেরিকা সফররত শীর্ষ নেতাদের আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর সংখ্যা কমিয়ে এনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও স্বাক্ষরের ব্যাপারে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াত সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চায়। শুধু উচ্চকক্ষে পিআরের দাবি মানলে দলটি মেনে নেবে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি। বিএনপি সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির দাবি মেনে নিয়ে জুলাই সনদে ছাড় দিতে পারে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপিকে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর-এর দাবি মেনে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অভিন্ন দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত এবং সরকার ও বিএনপিকে একধরনের চাপে রেখেছে জামায়াতে ইসলামী।
অন্যদিকে জুলাই সনদ নিয়ে প্রায় অভিন্ন অবস্থানে থাকা ১২-দলীয় জোট, ১১-দলীয় জোট, এলডিপি, এনডিএম, বিজেপি, লেবার পার্টি আছে বিএনপির সঙ্গে। ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের স্বার্থে জুলাই সনদে যেকোনো ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন ১২-দলীয় জোটের নেতারা। জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে যেকোনো মূল্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও স্বাক্ষর প্রক্রিয়ায় আমরা ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় ঐকমত্যের স্বার্থে যেকোনো ছাড়ের বিনিময়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আমরা একমত।’
ঐক্য ধরে রাখা এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য ইতোমধ্যে ৯টি রাজনৈতিক দল উদ্যোগ নিয়েছে। দলগুলো হলো গণতন্ত্র মঞ্চের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী জনশক্তি পার্টি এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণ-অধিকার পরিষদ। ইতোমধ্যে দলগুলো নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক করেছে। পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ, সনদের আইনি ভিত্তি ও সাংবিধানিক সভায় সংবিধানের সংস্কার চায় তারা। এই ৯টি দল মিলে নির্বাচনি বলয় বা জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। তবে এই বলয় এককভাবে, না কি বিএনপি বা জামায়াত বলয়ে যাবে, তা নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। কেউ কেউ প্রত্যাশিত আসনে ছাড় পেলে বিএনপি জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে অনাগ্রহী বেশির ভাগ নেতা। শিগগির এই ৯টি দল জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
শেয়ার করুন


