বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।এছাড়া কিশোরগঞ্জের হাওর দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যদি একটি রেখা কল্পনা করা যায়, এলাকাটি হচ্ছে দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। এ দুটি প্লেটের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত বার্মা প্লেট, পশ্চিমে অবস্থিত ইন্ডিয়ান প্লেট। এর সংযোগস্থলের উপরের ভাগটি অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে মণিপুর, মিজোরাম পর্যন্ত অঞ্চলটি ‘লকড’ হয়ে আছে। অর্থাৎ এখানে শক্তি জমা হয়ে আছে।
কী পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে- এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এ শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত (১৮ সেপ্টেম্বর) ১০টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে দেশে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূতাত্ত্বিক গঠনের তিন প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশে :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ভূতত্ত্ববিদ ও খ্যাতনামা ভূবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। বাংলাদেশের উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট, পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং পূর্বে হচ্ছে বার্মা প্লেট। তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সেটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওর হয়ে মেঘনা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরটা দেখেন, তাহলে দেখবেন যে এটি উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এবং মেঘনা নদীতে এসে পড়েছে। এটি দিয়ে যদি একটি কাল্পনিক রেখা টানেন তাহলে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান দিয়ে বার্মা ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগ ঘটেছে। অন্যদিকে, এটির পূর্বে বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট অবস্থিত। ইন্ডিয়ান প্লেট সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও মেঘনা নদীর লাইন বরাবর বার্মা থেকে নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের নিচে তলিয়ে যায় তখন আমরা বলি সাবডাকশন জোন। এ সাবডাকশন জোন সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত।
তিনি বলেন, পৃথিবীর যত বড় বড় ভূমিকম্প সবগুলোই এ সাবডাকশন জোনে সংঘটিত হয়েছে। জাপান, চিলি, আলাস্কায় বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। সেখানে যে ভূতাত্ত্বিক কাঠামো (সাবডাকশন জোন), একই কাঠামো আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্প খুবই ক্ষতিকারক। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের সাবডাকশন জোন এবং এর আশপাশের অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সেই ভূমিকম্পগুলো ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, নদী-নালার গতিপথের পরিবর্তন এনেছে। ১৭৬২ সালের আসাম ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদীর দিয়ে চলে যায়। আগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়েই এ নদের বেশির ভাগ পানি প্রবাহিত হতো।
আবিষ্কার হয়নি ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস :
সাবেক আবহাওয়া বিজ্ঞানী আব্দুল মান্নান বলেন, এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের প্রেডিকশন দেওয়ার মতো কোনো পদ্ধতি/প্রক্রিয়া আবিষ্কার হয়নি। যেহেতু এটি পৃথিবীর ইন্টারনাল বিহেভিয়ার এবং ইন্টারনালি লেট মুভমেন্ট এনার্জি রিলিজের মাধ্যমে এক প্লেট থেকে অন্য প্লেটে এনার্জি বিনিময় হয় বা কোনো কারণে যখন শক্তির পরিবর্তন হয়, তখনই ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ কিন্তু ইউনিফর্মলি সৃষ্ট নয়। এখানে ননউনিফর্মিটি আছে এবং সে কারণেই পৃথিবীর সব জায়গা সমানভাবে গঠিত হয় না। যেমন- জাপানে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প হয়। কিন্তু বাংলাদেশ বা এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে সেভাবে ভূমিকম্প হয় না।তিনি বলেন, অতীতে বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে ব্যাপক ভূমিকম্প হয়েছে। তার মানে, আমরা ভূমিকম্প এরিয়ার মধ্যেই আছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঘন ঘন ভূকম্পন হচ্ছে কেন? যেহেতু এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, এখানে বছরের কোনো এক সময় বা অতীতেও ভূমিকম্পের প্রবণতা ছিল, এখনও অতীতের মতো ভূমিকম্প প্রবণতা রয়ে গেছে। যেহেতু বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে, সেহেতু বাংলাদেশের উচিত হলো অতীতের রেকর্ডগুলো আমলে নিয়ে যতটা সম্ভব সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ, এটি এমন একটি দুর্যোগ, যেটির কোনো পূর্বাভাস নেই। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য আমাদের নিজেদেরই সতর্ক থাকতে হবে।
আব্দুল মান্নান বলেন, টেকটোনিক প্লেটগুলো থাকার কারণে পৃথিবীর সব স্থান কিন্তু মুভ করছে। তবে, এ মুভমেন্টটা আমরা ফিজিক্যালি দেখি না। কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি প্রতি বছর কিছু মিলিমিটার এটি মুভ করছে। সেই মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশও এখন দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে।এক প্রশ্নের জবাবে এ বিজ্ঞানী বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত পুরানো বিল্ডিংগুলো আস্তে আস্তে কোলাপস করছে। নতুন যেসব বিল্ডিং তৈরি করা হবে সেগুলো অবশ্যই ভূমিকম্প সহনীয় করে বা বিল্ডিং কোড মেনে করতে হবে। এটি বাধ্যতামূলক।
বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ, সক্রিয় তিনটি টেকটোনিক প্লেট :
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের আশপাশ দিয়ে তিনটি টেকটোনিক প্লেট গেছে। এগুলোর সংযোগস্থল আমাদের সীমান্তের আশেপাশে। যেমন- আমাদের উত্তরে হিমালয় পড়েছে ইউরেশিয়ান প্লেটে। আমাদের অবস্থান ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটে। আর আমাদের পূর্বে হচ্ছে বার্মার মাইক্রো প্লেট। এ তিনটি প্লেটই আমাদের কানেক্টেড এবং সক্রিয়। প্লেটগুলোর মুভমেন্ট আছে। এগুলো প্রতি বছরে পাঁচ সেন্টিমিটার বা ৫০ মিলিমিটার মুভমেন্ট করে। তার মানে, প্রতি বছর আমরা পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুভমেন্ট করছি। একইভাবে পুরো পৃথিবীও মুভ করছে।