এখলাছুর রহমান, জকিগঞ্জ: সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বাধার মুখে চার মাস থেকে বন্ধ রয়েছে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বাংলাদেশ অংশের ভাঙ্গন এলাকার মেরামত কাজ। এর ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে বন্যার হুমকিতে রয়েছে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলাসহ সিলেট অঞ্চলের ১০/১২টি উপজেলা। ২০২২ সালের বন্যার পর থেকে প্রায় তিন বছরেও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত কাজ শেষ না হওয়ায় সিলেট অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ বর্ষায় বন্যা-আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন।
জানা যায়, ভারত থেকে নেমে আসা বরাক নদী জকিগঞ্জের আমলশীদ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা-কুশিয়ারা নামে দু’দিকে প্রবাহিত হয়। নদী দু’টির প্রায় ৬৬ কিলোমিটার অংশ সীমান্ত নদী হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে কুশিয়ারার ৪১ কিলোমিটার ও সুরমার ২৫ কিলোমিটার আন্ত:সীমান্ত নদী।
বিগত বছরের বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার ডাইকের জকিগঞ্জ অংশের ২৫/৩০টি স্থান ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করে জনপদে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শতশত ঘরবাড়ি ও কয়েক হেক্টর ফসলি জমি। বন্যা-পরবর্তী সময়ে সেই বাঁধ মেরামত করতে গেলে গত বছরের নভেম্বর মাসে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ বাধা দেয়। ফলে আটকে যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ। বিএসএফের বাধায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত বা মাটি ফেলে ভরাট করা সম্ভব না হওয়ায় আগামী বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন সুরমা-কুশিয়ারা নদীপাড়ের বাসিন্দারা।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর প্রায় অর্ধশত স্থানের বাঁধ ভেঙে কয়েক দফা বন্যায় প্লাবিত হয় জকিগঞ্জ উপজেলাসহ পুরো সিলেট জেলা। বন্যা-পরবর্তী বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিগত অর্থ বছরে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শুরু হলে বাধা দেয় বিএসএফ। তারা সরাসরি বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে কাজ বন্ধ না করলে গুলির হুমকি দেয়। এতে দফায় দফায় বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় বাঁধ মেরামতের কাজ।
সরেজমিন জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মানিকপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বিশাল অংশ নতুন করে নদীতে ভেঙ্গে পড়েছে। ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে গাছপালা ও কৃষি জমি কুশিয়ারা গর্ভে চলে গেছে। একদিকে বিএসএফের বাধায় পুরাতন ভাঙ্গন অরক্ষিত, অন্যদিকে নতুন করে মানিকপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে মারাত্মক নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তঘেষা জনপদ জকিগঞ্জের মানুষ বর্ষায় বন্যা আতঙ্কে রয়েছেন।
রারাই এলাকার মাওলানা আলাউদ্দীন তাপাদার জানান, আমরা কুশিয়ারা পারের মানুষ চরম আতঙ্কিত। গত ২০২২ সাল ও ২০২৪ সালের বন্যায় রারাই ও ছবরিয়া পাশাপাশি দু’টি গ্রামে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। সম্প্রতি প্রতিবেশী মানিকপুর গ্রামে বিশাল এলাকাজুড়ে মারাত্মক নদী ভাঙ্গনের ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে বন্যার স্রোতে আমাদের আশপাশের ৮/১০টি গ্রামের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।
একই গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, বাঁধ মেরামত কাজ শুরু করলেই বিএসএফ বাধা দেয় এবং কাজ বন্ধ না করলে গুলি করারও হুমকি দেয়। তাদের বাধার কারণে এ বছর শুষ্ক মৌসুমে বাঁধে মাটি ফেলার কাজ করতে না পারায় এলাকার লোকজন আতঙ্কে আছেন।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহজালাল এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী ও জকিগঞ্জের বারহাল ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে জকিগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিএসএফ কোন ধরণের কাজ করতে দিচ্ছেনা। তারা বলছে, সীমান্তের ১৫০ গজের ভিতরে কোন কাজ করতে দিবেনা। কিন্তু আমাদের পুরাতন ডাইকগুলো সীমান্তের ৫০/১০০ গজের ভিতরে। আমরা আমাদের প্রয়োজনে যখন ডাইক মেরামত করতে যাই, ঠিক তখনই বিএসএফ শক্তভাবে আমাদের বাধা দেয়। কাজ বন্ধ না করলে কখনো কখনো গুলি করারও হুমকি দেয়।
সূত্র জানায়, কুশিয়ারার ৪১ কিলোমিটার ও সুরমার ২৫ কিলোমিটার আন্ত:সীমান্ত নদী। আইন অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের ভিতরে কৃষি কাজ, মাছ আহরণ ও পানি ব্যবহারসহ কিছু কাজ করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু স্থাপনা নির্মাণের কোনো বিধান নেই। তবে অতীতে নদীর বাঁধ নির্মাণের কাজে কখনো বিএসএফ বাধা দেয়নি। বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারার যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয় শুষ্ক মৌসুমে পাউবো সেসব স্থানে মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে। কিন্তু এবছর বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলে বিএসএফ বাধা দেয়। কোনোভাবেই তারা বাঁধ মেরামতের জন্য মাটি ফেলতে দেয়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুশিয়ারা নদীর ছয়লেন, মাইজকান্দি, ছবড়িয়া, শষ্যকুড়ি, বাখরশাল, মানিকপুর, রারাই গ্রামসহ ১০/১২টি এলাকা এবং সুরমা নদীর হাজীগঞ্জ ও বাল্লা গ্রামসহ ৫/৭টি এলাকায় বাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিএসএফের বাধার কারণে বাঁধ মেরামত করতে না পারায় আগামী বর্ষা মৌসুমে বিনা বাধায় পানি ঢুকবে লোকালয়ে। এতে উপজেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হবে। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ফসলহানি ঘটবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, বিএসএফের বাধার কারণে সুরমা ও কুশিয়ারার অন্তত ৩০টি স্থানে বাঁধ নির্মাণের কাজ করা যাচ্ছে না। এক্সেভেটর ও ড্রাম ট্রাক নিয়ে বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ করতে গেলেই বিএসএফ বাধা দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
শেয়ার করুন