বিলুপ্তির পথে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আসাম প্যাটার্নের বাড়ি

সিলেট

সংরক্ষণের অভাবে সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত আসাম স্থাপত্যরীতির স্থাপনাগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।

ছোট ছোট ইট, ইটের সুরকি ও চুন মিশিয়ে তৈরি এসব স্থাপনাগুলোর দেয়াল এবং কাঠ বা লোহার কড়ি-বর্গার উপর সুরকি-চুনের ঢালাই দিয়ে নির্মিত হতো পাকা বাড়ি। অতিবৃষ্টির জন্য অনেক সময় এসব ঘরের উপরে টিনের চাল দেওয়া হতো।

মোগল আমল থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সিলেটের বহু স্থাপনা গড়ে উঠেছিল এই আসাম ধাঁচের নির্মাণশৈলীতে। আধাপাকা কাঠের নল, বর্গা, কড়িকাঠের মাঝখানে নল, খাগড়া, ইকড়া ঘাসজাতীয় গুল্ম দিয়ে তৈরি বেড়ার উপর চুনসুরকির লেপন ও সাদা চুনকাম ছিল এই স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে পরবর্তীতে যুক্ত হয় ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলী।

সিলেট অঞ্চলে আসাম প্যাটার্ন বাড়ি বানানোর ধারা সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয় ১৮৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পর। সে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল এত বেশি যে সে সময়ের আগে নির্মাণ করা সিলেট অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দালাল ধসে পড়ে। আর ভূমিকম্পের আতঙ্ক তখন এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে মানুষ দালাল নির্মাণ করতে আর আগ্রহী না হয়ে ভূমিকম্প সহনশীল আসাম প্যাটার্ন বাড়ির দিকে ঝুঁকেন।

কালের পরিক্রমায় ইট, রড, সিমেন্ট ও প্রযুক্তির আধুনিকতার ফলে এসব স্থাপনাগুলোর স্থান দখল করেছে গগনচুম্বী অট্টালিকা। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে সিলেটে পাকা দালান নির্মাণের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বাড়ে। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই এখন আধুনিক বহুতল দালানের ছড়াছড়ি। এমনকি প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও গ্রামীণ পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন এই প্রাচীন স্থাপত্যরীতি আজ বিলুপ্তির পথে।

সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) ছাত্রাবাস ছিল আসাম স্থাপত্যরীতির একটি দৃষ্টান্ত। শতবর্ষী ঐতিহ্যের এই স্থাপনাটি ২০১২ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। একইভাবে নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আবু সিনা ছাত্রাবাসও ছিল আসাম ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির নান্দনিক নিদর্শন।

১৮৫০ সালে ইউরোপীয় মিশনারিরা তিন একর জায়গাজুড়ে ভবনটির নির্মাণ শুরু করেন। এটি দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ইতিহাস বহন করলেও, ২০২৪ সালে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটিও ভেঙে ফেলা হয়।

নগরীর চৌহাট্টায় অবস্থিত সিংহবাড়িও একটি প্রাচীন আসাম প্যাটার্নের স্থাপনা ছিল। এই বাড়িতে একসময় পদার্পণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু গুণীজন। তবে এই বাড়িটির শুধু সামনের অংশটি অক্ষত রেখে মূল বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।

এছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলার চারিগ্রামে রয়েছে সাজিদ রাজার বাড়ি, যেখানে তেরো চালা ঘর ও চুনসুরকির কারুকাজে তৈরি কাঠ-বাঁশের স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের মুখে। কামালপুর গ্রামে রয়েছে এমএ হকের পৈতৃক ভিটাও, যা সতেরো শতকের শেষ দিকে নির্মিত হয়েছিল। এসব স্থাপনার অনেকগুলোই বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত।

সিলেটের আসাম প্যাটার্ন বাড়ি নিয়ে সচিত্র গ্রন্থ লিখেছেন জার্মান প্রবাসী গবেষক সামছুল মজিদ চৌধুরি সাকী। তার লেখা বই ‘আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাইজেস ইন সিলেট’ এ উঠে এসেছে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বাড়িগুলোর ইতিহাস।

এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিমে রাইন-বার্গিশ অঞ্চলে ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দীতে তৈরি ঘরবাড়িগুলো দেখতে অবিকল আমাদের সিলেটের ঐতিহ্যগত আসাম টাইপ হেরিটেজ হাউসের মতোই! কেবল আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৈরি সিলেটি ঘরবাড়িগুলো অনেক বেশি নান্দনিক ও কারিগরি দিক থেকে অনেক বেশি টেকসই ছিল। অথচ, দোকানপাট, উঁচু দেয়াল আর এপার্টমেন্টকে জায়গা করে দিতে আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছে আমাদের ঐতিহ্য এই সুন্দর আসাম টাইপ হেরিটেজ হাউস।’

এ বিষয়ে ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সিলেট’-এর আহ্বায়ক আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, ‘আসাম প্যাটার্নের স্থাপনাগুলো আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংরক্ষণের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতা এগুলো ধ্বংস করছে। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।’

প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার বলেন, ‘সিলেটের প্রাচীন স্থাপনাগুলো রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। আমরা বহু আন্দোলন করেও আবু সিনা ছাত্রাবাস রক্ষা করতে পারিনি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আজও যেসব স্থাপনা আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, সিলেটে এখনও অনেক প্রাচীন স্থাপনা আছে। সেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের কাজ করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *