প্রায় ১০বছর যাবত ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রির কাজ করেন। প্রতি মাসে অন্তত ৩০-৩৫টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেন কামাল। সে হিসাবে গত ১০ বছরে অন্তত ৪ হাজারেরও বেশি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করছেন। কাজী কামাল চৌধুরী নামের সাথে কাজী যুক্ত করা এই কামাল চৌধুরী গাজীপুরের কাশিমপুরে ৫নং ওয়ার্ডের শৈলডুবি এলাকায় বসবাস করেন। তবে গাজীপুর মহানগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় কামাল চৌধুরী নামে কারো নাম নেই।
কাজী হিসেবে প্রায় যুগ পার করতে চলেছেন এই কামাল। পিতা নূর মোহাম্মাদ ও মাতা আমেনা বেগম মহানগরীর কাশিমপুর থানাধীন শৈলডুবি এলাকায় বসবাস করেন। একই এলাকার আবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতি শুক্রবার অন্তত ২ থেকে ৩টি বিয়ে হয়। আর বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এছাড়াও সপ্তাহের অন্যান্য দিনও কম-বেশি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়।সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন কামাল,রয়েছে কাজী অফিসও। নিজে যেমন অবৈধ ঠিক তেমনি অবৈধ ও ভুয়া জন্মসনদ ও এনআইডি দিয়েও নাকি যে কারও বিয়ে দিতে সক্ষম এই কাজী। কিন্তু বিনিময়ে গুনতে হবে ৪-৫ গুন বেশি অর্থ।
এমনও শোনা যায়, বৈধ কাগজপত্র থাকলে অন্যান্য নিবন্ধিত ও লাইসেন্সধারী কাজীদের চেয়ে তিনি অর্ধেক টাকা কম রাখেন। কাশিমপুরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রয়েছে এই কামালের বেশ কয়েকজন সহযোগী। যারা নিবন্ধিত ও লাইসেন্সধারী কাজীদের কাজে না নিয়ে কামালের কাছে বিয়ের জন্য লোকজন নিয়ে যান, এতে তারাও একটা কমিশন পান।
ভুয়া কাজী নিয়ে গাজীপুর মহানগরের থানাগুলোতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজী। যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর এখতিয়ার নেই। কাজী হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। এর অধিকাংশই গাজীপুর জজকোর্ট এলাকায়।কিছু অসাধু আইনজীবী ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বহুদিন ধরেই। অথচ ওই ভুয়া কাজীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ভাষ্য, এসব ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য ও অভিযোগ না পাওয়ায় এ নিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অবৈধ ও ভুয়া কাজী কামাল চৌধুরীর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, কোনাবাড়ি থানার ৮নং ওয়ার্ডের নিবন্ধিত কাজী আশরাফুল ইসলামের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছেন কথিত এই ভূয়া ‘কাজী’ কামাল। এরপর আরেকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এমন অবৈধ কাজ পুনরায় করবেন না বলে একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করছেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাজী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভুয়া কাজী কামালকে আমার এলাকায় অবৈধভাবে একটি বিয়ে পড়ানো অবস্থায় আমরা তাকে ধরি।এরপর একটি ভিডিও নেয়া অবস্থায় সে বারবার ভিডিও ধারণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করে এবং তার অবৈধ কাজের জন্য মাফ চায় এবং এই কাজ পুনরায় করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন।
সে ঘটনার ব্যাপারে অভিযুক্ত কামাল চৌধুরীর ভাষ্য হচ্ছে, কোনাবাড়ি বাস থেকে স্ট্যান্ড হতে আমাকে জোর করে ধরে একটি কক্ষে নিয়ে ১৫-২০জন এলোপাতাড়ি মারধর করে আমার থেকে ৭ লক্ষ টাকা দাবি করা করে। এবং এক পর্যায়ে মুখে কিছু একটা স্প্রে করে আমার থেকে একটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া নেয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, কাজী হিসেবে আমার কোন নিবন্ধন নাই, আমি আমার এক ভাইয়ের (যিনি ঢাকার ধামরাইতে কাজ করেন) ‘সাব কাজী’ হিসেবে কাজ করি আমার এলাকায় (কাশিমপুরে) তিনি তার বিরুদ্ধে উঠা ভুয়া কাগজপত্রে বিয়ে সম্পন্ন করা, বৈধ কাবিননামা না দিতে পারা, ভূয়া বালাম বইতে কাবিনসহ অন্যান্য অভিযোগসমূহ অস্বীকার করেন।
এ দিকে কাশিমপুর, কোনাবাড়ীসহ আশপাশের থানাগুলোর অলিগলিতে কাজী আছে, অফিসও আছে, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার,সরকার নির্ধারিত বালাম বইও।তবে সেটা ভুয়া। তাদের নেই আইনগত কোনো বৈধতা। সেই সাথে কাজীর নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও কথিত কাজী পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর। শুধু পাড়া-মহল্লায় নয়,কোর্ট চত্বরেও চলছে ভুয়া জন্মসনদ,নকল কাবিননামা আর জাল সিল-স্বাক্ষরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি। জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত এই গাজীপুর মহানগরের থানাগুলোতে কাজের খোজে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে।নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।এসব নামসর্বস্ব কাজীর ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
আসল ভেবে ভুয়া কাবিননামা,তালাকনামা দাখিল করে সম্পত্তির অধিকার,পিতৃত্ব ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিতের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবুও ভুয়া কাজীদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে গণমাধ্যমে খবর আসলেও প্রতিকার মিলছে।ফলে পাড়া-মহল্লাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কাজী অফিস।বেপরোয়াভাবেই চালাচ্ছেন তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড।
জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার তথ্য নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে। এমন অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ,নিয়োগ,স্থায়ীকরণ,জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
তাদের মতে, ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্য কমাতে নিকাহ-তালাক নিবন্ধনে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিয়ে ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর সুরক্ষায় ডিজিটালাইজড রেজিস্ট্রেশনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে গাজীপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট ও ৫নং ওয়ার্ডে বসবাসরত সুরুজ মিয়া বলেন, বর্তমান সময়ে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার প্রবণতা বেড়েছে। তথ্য গোপন করে একজন ব্যক্তি একাধিক বিয়ে করছে।তালাকও দিচ্ছে।এটা হওয়ার কারণ বিয়ে ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড না হওয়া। আবার অনেক সময় নিবন্ধনহীন ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি করে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে।বিয়ের বৈধতা না থাকায় পরবর্তীতে তারা আইনগত সুবিধা পাচ্ছে না। তাই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা ও কাজীদের নিবন্ধনের বিষয়টি ডিজিটাল হওয়া সময়ের দাবি। এটা কার্যকর করতে পারলে বিয়েতে প্রতারণার দরজা বন্ধ হবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,অবৈধ ও ভুয়া কাজীরা খুবই শক্তিশালী। তাদের আইনের আওতায় আনা অসম্ভব। কারণ তারা একটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। এতে সারা দেশের ভুয়া কাজীরা জড়িত আছে এবং সব একত্রিত হয়ে অর্থ ঢেলে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে। তাদের বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে, ভুয়া বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রিসহ বেআইনিভাবে বিয়ে পড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এর আগেই তারা আদালতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রিট মামলা করেন। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।কর্মকর্তারা জানান,ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার অনেক কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে।সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৮ হাজারের কাছাকাছি নিবন্ধিত কাজী রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সব কাজী রয়েছেন তারা অবৈধ। এ সংখ্যা প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ তাদের কোনো নিবন্ধনপত্র নেই।
ভুয়া কাজীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট সুরুজ মিয়া বলেন, অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দণ্ডবিধিতে আছে। দণ্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজির এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজীর রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার সামিল। অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় ভুয়া কাজী ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
শেয়ার করুন