মব জাস্টিস ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি

জাতীয়

২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তসলিমা বেগম রেনু নামে এক নারীকে। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ছাত্র-জনতা। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এর বিচার এখনও নিশ্চিত হয়নি। তাসলিমা বেগম রেণুর কনিষ্ঠা কন্যা চার বছর বয়সী তাসমিন মায়ের জন্য মাঝেমধ্যেই ভেঙে পড়ছিল কান্নায়। কিন্তু সে বুঝতেই পারছিল না, তার মা আর কখনো ফিরবে না। মা না আসলে সে খাবে না বলে জেদ করছিল।

তার বড়ভাই ১১ বছর বয়সী তাহসিন আল মাহিন অন্তত বুঝতে পেরেছিল, তাদের মা আর কোনোদিন ফিরবেন না। বোনকে সান্তনা দেওয়ার অবস্থা অবশ্য তার নেই। কে নেবে তাদের দায়িত্ব? শৈশবেই মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত হল। এই দায় কার? কী হতে পারে এর প্রতিকার?

মব জাস্টিস কি?

মব জাস্টিস একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। মব (Mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Justice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। একে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার, মব রুল বা মবোক্রেসি কিংবা ওখলোক্রেসি বলেও প্রকাশ করা হয়। ‘মব জাস্টিস’ বলতে আইন জনতা নিজের হাতে তুলে নেওয়া বোঝায়। অপরাধীকে আইনানুগ বিচারের আওতায় তুলে না দিয়ে নিজেরাই শাস্তি দেওয়াকে ‘মব জাস্টিস’ বলা হয়।
এটি একটি নিকৃষ্ট কাজ। ফলে সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থান চিত্রিত হয়। মব জাস্টিস হল একটি ফৌজদারি অপরাধ, যা ১৯৬০ সালের ফৌজদারি কোডের ২৯ আইন অনুযায়ী জনতার বিচারের বিভিন্ন দিককে ইঙ্গিত করে। ধারা ৪৬ অনুযায়ী, যে খুন করবে সে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করবে।

মব জাস্টিসের সূত্রপাত কিভাবে হয়?

মব জাস্টিসের অপসংস্কৃতি ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে মব জাস্টিসের পাশবিক ও ভয়াবহ রূপের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী এ উপমহাদেশের জনসাধারণ। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা, গুজব, উত্তেজনা বৃদ্ধি, অভিযুক্তের ধরপাকড় ইত্যাদির সুবিচার না হলে অথবা কারো প্রতি আক্রোশের বশবর্তী হয়ে এ ধরণের ঘটনা ঘটানো হয়। অনৈতিক স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ব্যক্তি, বিভিন্নভাবে জুলুমের শিকার হয়েও সুবিচার না পাওয়া ব্যক্তি ও উগ্রপন্থীদের দ্বারা এমন ঘটনা ঘটে থাকে।

বাংলাদেশে মব জাস্টিস

 

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান মতে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ২৪ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলাও হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। চলতি বছর ১৪ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে সাঈদ আরাফাত শরীফ (২০) ও সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন (১৯) নামে দুই যুবককে গণধোলাই দেওয়া হয়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দেশে গত দুই মাসে ৩৩ জনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ, বহুল আলোচিত-সমালোচিত জাবিতে শামীম মোল্লা ও ঢাবিতে তোফাজ্জল হত্যা।

 

মব জাস্টিস বৃদ্ধির কারণ

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দ্রুততম সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে জনরোষের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। এতে তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিজের সোর্স মারফত তথ্য পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসা, এটা তাদের দায়িত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এমন নজির খুবই কম। বরং, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সচেতন নাগরিকগণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় ফোন করলেও সেটার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

 

বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক না থাকায় ন্যায়বিচার খুবই সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিচার প্রত্যাশীরা অধৈর্য হয়ে পরেন। বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়টিও নতুন কিছু নয়। আইনি লড়াইয়ের পর ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষীণ। এ দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় দেওয়ার মত সময় ও অর্থ সবার কাছে থাকে না।

সমাজের নিম্নস্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের রাজত্ব। সুযোগ পাওয়ার পরেও সৎ হয়ে চলা ব্যক্তির সংখ্যা অতি নগণ্য। এছাড়াও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ একেবারেই শূন্যের কোটায়। বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের মানবিকতা হ্রাস পাচ্ছে। হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়ে চলছে নগ্ন কাদা ছোড়াছুড়ি। এ সব ছোটখাটো ঘটনাই একটা সময় বড় আকারে আবির্ভূত হচ্ছে। বিভিন্নরকম গুজব ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ির ফলে মানুষের মনে উগ্রবাদ বাসা বাধে। তারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই গুজবে বিশ্বাস করে অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। বিভিন্ন দলের মুখোমুখি অবস্থান কর্মসূচীগুলোর ফলেও বিচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড ঘটে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাঠের পরিমাণ খুবই কম। দেশের জনগণের একটি বড় অংশ মব জাস্টিসকে অপরাধ বলে মনেই করে না। এর ফলে কোনো অপরাধী মারা গেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এতে করে মানুষ মব জাস্টিসের প্রতি উৎসাহিত হয়। অনেকে এ সব ঘটনাকে বাহবাও দেয়। বিগত দেড়যুগ যাবৎ ঘটে যাওয়া অন্যায়, জুলুমের বিচার সবারই কাম্য। এই দীর্ঘ সময়ে জুলুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা সুবিচার পাওয়ার আশায় আইনের দ্বারে দ্বারে কড়া নাড়ছেন। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় রাতারাতি বিচারকার্য সম্পন্ন করা কখনোই সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনি সংস্থাগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। অত্যাচারে অতিষ্ট হওয়া জনতা এসব মানতে নারাজ।

মব জাস্টিস প্রতিরোধে করণীয়

মব জাস্টিস প্রতিরোধে প্রথম ও প্রধান  যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ইত্যাদির উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৎ, দক্ষ, আইনজ্ঞ নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌক্তিক সংস্কার আনতে হবে। পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দিলে যেমন অন্যায়ের পরিমাণ কমবে, তেমনই অন্যায়কারীদের প্রতি অবিচার জুলুমের প্রবণতাও হ্রাস পাবে। মৌলিক আইনগুলো জনগণকে অবগত করতে হবে। মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে ফৌজদারি অপরাধে মব জাস্টিসকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা ও শাস্তির প্রবিধান উল্লেখ করা এখন সময়ের দাবি।

এ ধরনের খুবই অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উগ্র-বর্বর জাতি হিসেবে আমাদের চিহ্নিত করে। ফলে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার মত ভয়াবহ পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়। উন্নত রাষ্ট্র গড়ার পথে এ ধরনের পরিস্থিতি প্রতিকূলতার পাহাড় সৃষ্টি করবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বাংলাদেশে এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। এতে করে জনগণ আইনের শাসনের উপর নিজেদের আস্থা হারাতে বসেছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা দূর করতে জনগণের নৈতিক মানোন্নয়নও জরুরি। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ গড়তে পারলেই কেবল মব জাস্টিস দূর করা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *