যন্ত্রপাতি লুটপাট, স্থাপনা ধ্বংস, গাছপালা কেটে ও জমি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করে বিলীনের পথে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনা ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে (বাংকার)। প্রতিদিন শত শত মানুষ পাথর উত্তোলন করায় এর অস্তিত্ব বিলীনের অপেক্ষা মাত্র। মাস দু-একের মধ্যে হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অবশিষ্ট জমিটুকুও। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হচ্ছে এখান থেকে। দিনে আরএনবি সদস্যরা ডিউটি করলেও তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। বরং রাতের বেলা নৌকাপ্রতি ৫’শ টাকায় বৈধতা পেয়ে যায় পাথর পরিবহন।
২০১৪ সালে জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ের এক যৌথসভায় ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে রোপওয়েটিকে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা করতে পারেনি। রক্ষা করতে না পেরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার আগে রোপওয়েটি লিজ দিতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
৩৫৯ একর জমি নিয়ে ১৯৬৪ সালে গড়ে উঠে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাব-সেক্টর তাদের চিকিৎসালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। সেখানে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিও। এই বাংকারে পাথর ক্রাশিং করে রজ্জুপথের মাধ্যমে সরাসরি ছাতক পাঠানো হতো। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেত এই পাথর। কিন্তু সম্প্রতি লুটপাট আর পাথর উত্তোলনে প্রায় বিলীন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটি। ধ্বংস করা হয়েছে সকল স্থাপনা, লুটপাট করা হয়েছে সব ধরনের যন্ত্রপাতি ও মালামাল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেটের ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে ৫টি সাব-সেক্টর ছিল। যার একটি ছিল ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টর। এমএনএ মোহাম্মদ আবদুল হকের নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জ উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করা হয়। পরবর্তীকালে মদরিছ আলীর (বিএ) নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জ উপ-আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয় এবং এই সংগ্রাম কমিটির তত্ত্বাবধানে ৭১ সালের আগস্ট মাসে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প এলাকায় (বাংকার) ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের প্রধান ক্যাম্প স্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রোপওয়েটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় টানা আট বছর বন্ধ থাকে। সংস্কার শেষে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে এটি আবার চালু করা হয়। এরপর থেকে রজ্জুপথ সচল রাখা হয় কেবল বর্ষা মৌসুমে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছর থেকে এ রোপওয়ে দিয়ে পাথর পরিবহন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় একটি খুঁটি হেলে পড়লে ফের বন্ধ হয়ে যায় রোপওয়েটি। এরপর ২০১১ সালে আবার চালু করার পর ২০১৪ সালের জুলাইয়ে আরেকটি খুঁটি উপড়ে পড়ে। তখন থেকেই সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে রজ্জুপথটি। তবে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ের এক যৌথসভায় ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে রোপওয়েটিকে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও এখন পর্যন্ত এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে দিন দিন বেহাল হতে হতে স্থাপনাটির অস্তিত্বই এখন ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন।
১৯৬৪-৬৯ সালে দুই কোটি ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। এর দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার ও টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্লান্টের সংখ্যা ছিল ১২০টি। রেলওয়ের রোপওয়ে প্রকল্প হিসেবে ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। ভোলাগঞ্জ লোডিং স্টেশন (বাঙ্কার) থেকে পাথর বাকেটে করে সরাসরি ছাতকে খালাস স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হতো। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউসের মাধ্যমে এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করতেই রজ্জুপথের প্রতিষ্ঠা হয়। চলাচলের পথ দুর্গম হওয়ায় মানুষেরও যাতায়াত ছিল এই রজ্জুপথে। রজ্জুপথ দিয়ে ২০০টি বক্স চলাচল করত। প্রতি বক্সে ৬০০ কেজি ওজনের ১২ ঘনফুট পাথর পরিবহন হতো। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার ঘটলে ট্রাক দিয়ে পাথর উত্তোলন দ্রুত হওয়ায় রজ্জুপথের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যায়।
জানা যায়, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে রোপওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমির মধ্যে ভাটরাই মৌজায় ২১৩.০৪ একর, কালাইরাগ মৌজায় ৩০.৫৪ একর ও কালাসাদক মৌজায় ৯৯.৮১ একরসহ ছাতক-ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত রোপওয়ের ট্র্যাসেল বরাবর আরও ১৬.৪৮ একরসহ মোট ৩৫৯.৮৭ একর। পাথর উত্তোলন করে ভোলাগঞ্জ বাংকারে অবস্থিত ৩৪৩.৪৫ একর জমির প্রায় তিন চতুর্থাংশ বিলীন করে দেওয়া হয়েছে। জমি, অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি দেখভাল করতে ২০০০ সাল থেকে আনসার বাহিনী দায়িত্বে ছিল। কয়েক বছর পর আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে রেল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আনসার বাহিনীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেয় রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি। একজন পরিদর্শক ও দুজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে ৪৮ সদস্যের আরএনবি দল সার্বক্ষণিক অবস্থান করে পাহারায় নিয়োজিত হয়। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তারা রাত-দিন সেখানে ডিউটি করে। ৬ আগস্ট রাতে পাথরখেকোরা তাদের উপর হামলা করলে সেখান থেকে আরএনবি সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। তখন থেকে শুরু হয় যন্ত্রপাতি লুটপাট মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন ও স্থাপনা ধ্বংসের কার্যক্রম।
গত ৪ জানুয়ারি ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ আফজাল হোসেন। তিনি পরিদর্শন শেষে জানান রোপওয়ের এই জায়গার যে অবস্থা তাতে এভাবে আর সংরক্ষণ করা যাবে না। কোন প্রাইভেট কোম্পানি পর্যটনের জন্য ভাড়া নিতে চাইলে তাদেরকে লিজ দেওয়া হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোপওয়ে ইঞ্জিন রুমের ছোট-বড় মটর কয়েলের বান্ডিল জেনারেটর ও জেনারেটরের পার্টস রোপওয়ের ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল, লোহার স্পেনসহ সব কিছু নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। রেহাই পায়নি স্কুল, মসজিদ, রেস্টহাউজ, মুক্তিযোদ্ধা সমাধি, শতবছরের গাছপালা। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে লুট করা হচ্ছে পাথর। কেটে নেওয়া হচ্ছে গাছপালা ধ্বংস করা হয়েছে স্থাপনা। মসজিদ ও কোয়ার্টারের নিচে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলন করায় দেয়াল ধসে পড়েছে। তবে দিনের বেলা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) সদস্যরা ডিউটি করায় দিনে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। আর রাতে আরএনবি সদস্যরা ডিউটিতে না থাকায় সে সময় চলে পাথর উত্তোলনের ধ্বংসযজ্ঞ। এভাবে লুটপাট চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের ঐতিহ্যের ধারক ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের সংরক্ষিত জায়গা পুরোটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে গত বছরের ২৫ নভেম্বরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনাও হয়। সেখানে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে বিজিবিকে ১০ দিনের সময় দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় উন্মুক্ত আলোচনা করতে আসেন এবং সে উন্মুক্ত আলোচনায়ও পাথর লুটপাট চাঁদাবাজি হচ্ছে মর্মে উপস্থিত অনেকে অভিযোগ তুলেন উপজেলা প্রশাসনের উপর।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) কমান্ড্যান্ট মোহাম্মদ শফিকুল বলেন, বাংকার এলাকায় আমাদের আরএনবি সদস্যরা ডিউটি করছে। দিনের বেলা ডিউটি করলেও রাতে সেখানে ডিউটি করার পরিবেশ নাই। সেখানে এমন পরিবেশ যে আমার সদস্যরা যদি রাতে ডিউটিতে যায় তাহলে পাথরখেকোরা তাদের উপর হামলা চালায়। এখানে আগে ১৪৪ ধারা জারি ছিল। এখন আবার আমরা জেলা প্রশাসকের বরাবর ১৪৪ ধরা জারি করার জন্য আবেদন করেছি। ১৪৪ ধার জারি করা না হলে সেখানে রাতে ডিউটি করা সম্ভব হবে না এবং বাংকার এলাকা রক্ষা করাও সম্ভব হবে না।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা আক্তার মিতা বলেন, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে রক্ষায় আমরা সকল বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করেছি। আরএনবি সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সেখানে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করার কথা রয়েছে। প্রয়োজনে তারা অন্য বাহিনীর সহায়তা নিতে পারেন। এছাড়া ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে এলাকা রক্ষায় আমরা কাজ করছি।
শেয়ার করুন