শেষ সময়ে সিলেট-৫ আসনে শক্ত ত্রিমুখী লড়াই শুরু হয়েছে। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাব্বির আহমদ নির্বাচন বর্জন করে সরে দাঁড়িয়েছেন। এখন মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আছেন নৌকা প্রতীকে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আহমদ আল কবির (ট্রাক) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী (কেটলি)। তাঁরা তিনজনকে ঘিরেই ভোটারদের শেষ সময়ের জল্পনা কল্পনা চলছে। আওয়ামী নেতাকর্মীরাও তিনভাগে বিভক্ত। শুক্রবার সকাল থেকে আনুুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেলেও শক্তিশালী এই প্রার্থীরা নিরবে জয়ের জন্য শেষ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন। সময় ঘনিয়ে আসায় ভোটাররা নানা হিসাব-নিকাশ টানছেন। নিরব ভোটে বড় ব্যবধানে জয় পরাজয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইজ্জত বাঁচাতে উল্লেখযোগ্য ভোট টানতে শেষ কৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন তিন প্রার্থীই। জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে এবার ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ২ হাজার ৩২৫ জন।
সিলেট-৫ আসনে ইসলামপন্থী দল ঘরানো ভোটের প্রভাব বহু পুরনো। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রায় সবকটি জাতীয় নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর নেতারা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নেমে নির্বাচিত হয়েছেন কিংবা নিকটতম স্থান দখল করে নিয়েছেন। এবারও ভোটের মাঠে একই চিত্র। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাসুক উদ্দিন আহমদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আহমদ আল কবিরের সঙ্গে আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী ছাহেব (র.) এর কনিষ্ঠ ছেলে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা গড়ে তুলেছেন।
ভোটাররা মনে করছেন, এই তিন প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। জকিগঞ্জ উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী ও স্বতন্ত্র ড. আহমদ আল কবিরের অবস্থান কিছুটা সুবিধাজনক হলেও সংসদীয় আসনের কানাইঘাট উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাসুক উদ্দিনের ভোট ব্যাংক শক্তিশালী। এ কারণে শেষ পর্যন্ত কানাইঘাট উপজেলার ভোটে যিনি বড় ভাগ নিজের প্রতীকে আনতে পারবেন তিনিই মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আসবেন। অন্যদিকে জাপা প্রার্থী শাব্বির আহমদ নির্বাচন বর্জন করায় নতুন হিসেব নিকেশ শুরু হয়েছে। জাপার ভোট কার বাক্সে যাবে। তবে শেষ সময় জাপার একটি অংশ ড. আহমদ আল কবির এবং আরেকটি অংশ মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। অন্য একটি অংশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের ওবায়দুল হক এবং ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ফরিদ উদ্দীন চৌধুরী এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সপ্তম ও নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী দ্বিতীয় হন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক দ্বিতীয় হন। বিগত সব কটি সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতারা প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছেন। ফলে এখানে ভোটের মাঠে বরাবরই ইসলামি দলগুলোর ‘ভোটব্যাংক’ সব সময় আলোচনায় থাকে।
দুটি উপজেলার একাধিক ভোটার ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে পাশে ছিলেন। নির্বাচনী এলাকায় তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। গ্রামে’গঞ্জে রয়েছে ব্যাপক পরিচিত। দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র হয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করা বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আহমদ আল কবিরও রাজনীতির মাঠে শক্তিশালী হয়ে ওঠেছেন। দলের বড় একটি অংশের নেতা কর্মীরা তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। রাজনীতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ড. আহমদ আল কবিরের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি কাজ করে থাকেন। ফলে তিনিও ভোটারের আস্থার জায়গা অর্জন করে নিয়েছেন। নৌকার বিজয়ে তিনিই এখন ফ্যাক্টর। স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী সাবেক মহাজোট নেতা। ২০০৬ সালের নির্বাচনে তিনি মহাজোট থেকে নৌকা পেয়েছিলেন। পরে নির্বাচনে যায়নি আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে তিনি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতেন। এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী তাঁর পক্ষে রয়েছে। পাশাপাশি এ আসনে আলেম ওলামা ঘরানো ভোটের প্রভাব থাকায় তিনি অনেকটা ফায়দা পাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার তাঁর শেষ নির্বাচনী জনসভায় ক্বওমী ঘরানোর আলেমরা প্রকাশ্যে মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ায় তিনি আরও সুবিধাজনক অবস্থান পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে এখন ফ্যাক্টর প্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, এ আসনে এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে মাসুক উদ্দিন আহমদ ও ড. আহমদ আল কবিরের পক্ষে দুটি অংশ সক্রিয়। আরেকটি বৃহৎ অংশ পর্দার আড়ালে হুছামুদ্দীনকে নিয়ে সক্রিয় আছে। ওই পক্ষ যেকোন মূল্যে হুছামুদ্দীনকে জিতিয়ে আনতে শেষ চেষ্টা করছে। তাঁদের কর্মী-সমর্থকেরা হুছামুদ্দীনের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। দুটি উপজেলায় ছাত্রলীগের উপজেলা কমিটি হুছামুদ্দীন চৌধুরীর পক্ষে গণসংযোগ করেছে।
জানতে চাইলে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও দলের মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের কল্যাণে অনেক উন্নয়ন করেছে। উন্নয়নের জন্য মানুষ নৌকায় ভোট দেবেন। দলের প্রকৃত কোন মানুষ অন্য কোন কাউকে ভোট দেবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের জন্য জনগন তাঁকেই নির্বাচিত করবেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী বলেন, ভোটারের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। অবাদ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ হলে সর্বদলীয় মানুষ আমার প্রতীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। আমি সংসদে গেলে অসহায় বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলবো। নির্বাচনের পরিবেশ এখনো ভালো আছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আহমদ আল কবিরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ভোটের পরিবেশ নিয়ে আমি তেমন একটা সন্তুষ্ট নয়। আমার সমর্থকদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। এ আসনের মানুষ আমাকে ভালোবাসে। এক প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে বিশেষ মহল ভয়ভীতি সৃষ্টি করায় সাধারণ ভোটার কেন্দ্রবিমুখ হওয়ার আশঙ্কা আছে। অবাদ, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হলে বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
এ আসনে এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শাব্বির আহমদ নির্বাচন বর্জন করেছেন। এখনো প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার কুতুব উদ্দিন শিকদার, কংগ্রেস প্রার্থী বদরুল আলম, মুসলিম লীগ প্রার্থী মো. খায়রুল ইসলাম। তবে তাদেরকে ঘিরে ভোটারের কোন আগ্রহ নেই।
শেয়ার করুন