সরকারের জুলুম–নির্যাতন বাম ও ডান সবাইকে এক কাতারে এনেছে

রাজনীতি

সরকার পতনের আন্দোলনে ঐক্যের আহ্বান নিয়ে এক টেবিলে বসেছে বিএনপি এবং দেশের ডানপন্থী ও বামধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দল। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আহ্বানে অনুষ্ঠিত সংলাপে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন, সরকার পতন ও রাষ্ট্র মেরামতে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে নেতারা একমত হয়েছেন।

বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এর আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংলাপের শেষ দিকে বলা হয়, অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন সংলাপে।

সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ, গণফোরামের একাংশ, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ, ভাসানী পরিষদ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশ।

আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সংসদ নির্বাচনের দিন সবাইকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। সংলাপের শেষে এ আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ইসলামি দল জালেম সরকারের সঙ্গে হাত মেলাবেন না। স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসীরা নীলনকশার নির্বাচনে যাবেন না।’ তিনি বলেন, সংলাপ শুরুর আগেও উপস্থিতি নিয়ে সংশয় ছিল। সবাইকে দেখে বুক ভরে গেল। সবার মতামত পাওয়া গেল। অচিরেই করণীয় উপস্থাপন করা হবে।

সংলাপের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের দায়িত্ব ইসলামী আন্দোলনকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম আজ বাম–ডান সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। মজলুমদের ঐক্য হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বস্ত নেতৃত্ব চায়, এ দায়িত্ব নিতে হবে।’

জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ইতিমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়ে গেছে। সবাই এখানে একত্র হয়েছে। তিন বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামী একসঙ্গে ডাক দিলে একাত্তরের মতো সবাই নেমে আসবে সরকারের বিপক্ষে।

প্রথমবারের মতো ইসলামি দলের সভায় অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন শুধু ঘরের লোক নয়, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে ডাকতে হয়। দেশে আগুন লেগেছে বলেই প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ইসলামি ধারার সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সরকারকে বড় একটা ধাক্কা দেওয়া দরকার, যেখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বলেন, ভোটের মর্যাদা না রাখায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবাই নেমেছিল। এ সরকারের বিরুদ্ধেও যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। এমনিতেই চড়া দামের জন্য বাজারে যাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক অবরোধ এলে দেশের জনগণ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী বলেন, দেশের জন্য, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, মানবাধিকারের জন্য দেশের বাম ও ডান এক টেবিলে বসাটাই একটি বড় বিষয়। সরকার উৎখাতে যা করা লাগবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করতে হবে।

এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, দুই কারণে ঐক্য হয়। একটি হলো লাভের জন্য, অন্যটি ভয় থেকে। মানুষকে তার অধিকার হারানোর বিষয়টি হয়তো বোঝানো যাচ্ছে না। এক সপ্তাহের খোরাকি হাতে নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে।

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিরোধ করা যায়নি। ২০১৮ সালে ‘ভোট ডাকাতি’ হয়েছে। এ সরকারের সঙ্গে সংলাপ করে কিছু হবে না। দল–মত সবাই মিলে রাজপথের আন্দোলনে নামতে হবে। না হলে কিছুই হবে না।

সংলাপ সঞ্চালনা করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। এতে আরও বক্তব্য দেন এলডিপির মহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, এনডিপির চেয়ারম্যান কে এম আবু তাহের, ভাসানী পরিষদের হাবিবুর রহমান, বিএফইউজে সভাপতি এম আবদুল্লাহ, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি খলিলুর রহমান মাদানী, গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ।

বক্তারা ঘরে বসে আলোচনার চেয়ে রাজপথের আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, সরকারি দল নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে ডামি প্রার্থী দিচ্ছে। সাজানো নির্বাচন করতে যাচ্ছে। তাই সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। রাজপথে শক্ত আন্দোলন করতে না পারলে ‘ফ্যাসিবাদের’ পতন হবে না।

এর আগে সংলাপের শুরুতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। এতে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো, ‘বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন ঘোষিত একতরফা’ তফসিল বাতিল করে গ্রেপ্তার বিরোধী–দলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিতীয়টি হলো, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর তৃতীয় প্রস্তাব, কার্যকরী সংসদ, রাজনৈতিক সংহতি এবং শতভাগ জনমতের প্রতিফলনের জন্য সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, একতরফা নির্বাচন নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে বিরোধী মতকে স্তব্ধ করার জন্য বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সরকার। বাংলাদেশের বিরোধী দল নির্বাচনের আগে চরম দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, শত শত মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা, গায়েবি মামলা ও বিরোধী দলের মৃত ব্যক্তির নামে কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। জেলখানার ধারণ ক্ষমতার তিন গুণ আসামি কারাগারে বন্দী। এটি সম্পূর্ণ মানবতাবিরোধী, অমানবিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ।

ইসলামী আন্দোলনের অভিযোগ, সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *