সিঙ্গাপুর-দুবাই হতে গিয়ে দেউলিয়া শ্রীলংকা

বিশ্ব

নিলাম কুলুনা টাওয়ারটি নির্মাণ হয়েছে সবুজডাঁটা থেকে বেরিয়ে আসা পদ্মফুলের আদলে।১ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারটি দক্ষিণএশিয়ার সর্বোচ্চ স্থাপনা। রাজধানী কলম্বোরবুকে বিলাসবহুল হোটেল রুম, শপিং মল, ডিজিটাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক অবকাঠামোনিয়ে গড়ে তোলা এক দর্শনীয় স্থাপনা নিলামকুলুনা টাওয়ার। টাওয়ারটি নির্মাণে অর্থায়নকরেছে চীন, ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ডলার।পর্যটকদের সামনে কলম্বোকে দুবাই বাসিঙ্গাপুরের সমকক্ষ হিসেবে তুলে ধরারউদ্দেশ্য থেকে ২০১২ সালে স্থাপনাটি নির্মাণেপ্রকল্প হাতে নিয়েছিল তত্কালীন মাহিন্দারাজাপাকসে সরকার। নিজ পরিবারেরশাসনের গৌরবের বিমূর্ত উপস্থাপন হিসেবেটাওয়ারটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেনমাহিন্দা রাজাপাকসে।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ টাওয়ারটি এখন একপ্রকার পরিত্যক্ত মৃত্যুপুরী। রাজাপাকসেভাইদেরও ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হয়েছে।দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তারা। আরটাওয়ারটিকে দেখা হচ্ছে তাদের সময়ে নেয়াঅনেক অযৌক্তিক শ্বেতহস্তী প্রকল্পের অন্যতমহিসেবে।

টাওয়ারটি থেকে গোটা কলম্বোই দেখা যায়।সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দৃশ্যগুলোর একটি হলোড্রেজার ও ক্রেনের ভিড়ে সাগর ভরাট হয়েনতুন এক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলারদৃশ্য। ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করাহচ্ছে পোর্ট সিটি কলম্বো নামে সম্পূর্ণ নতুনএক শহর। নির্মীয়মাণ অঞ্চলটি আয়তনেলন্ডনের মধ্যভাগের সমান। এখানেও মূলঅর্থায়ন চীনের। প্রকল্পটি নিয়ে রাজাপাকসেপরিবার ও তাদের সমর্থকদের দাবি, ভবিষ্যতে দুবাই ও হংকংয়ের মতো এশিয়ারঅন্যতম বড় আর্থিক হাব হয়ে উঠবে অঞ্চলটি।এর নকশাও করা হয়েছে দুবাই, সিঙ্গাপুর ওহংকংয়ের সঙ্গে মিল রেখে। ব্যাপকরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেপ্রকল্পটির কাজ এগিয়ে চললেও বর্তমানে এরভবিষ্যৎ নিয়েই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।সমালোচকরা বলছেন, প্রকল্পটি থেকেশ্রীলংকার লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনাইনেই। বৈদেশিক ঋণের বোঝা ভারী করে তোলাছাড়া শ্রীলংকার আর কোনো উপকারে আসছেনা প্রকল্পটি। এমনকি এখানে বিনিয়োগেরক্ষেত্রেও লাভের অর্থ চলে যাবে চীনেরতহবিলে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায়অঞ্চলটি হয়ে উঠতে পারে মুদ্রা পাচারের স্বর্গ।

গত দুই দশকের বড় একটি সময়রাজাপাকসে পরিবারের শাসনাধীনে ছিলশ্রীলংকা। এ সময় দেশটিতে উচ্চাভিলাষী ওব্যয়বহুল অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছেরাজাপাকসেদের আগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে।বাস্তবায়ন শেষেও এসব প্রকল্প শ্রীলংকারজন্য অনেকটা শ্বেতহস্তী পোষার সমান হয়েউঠেছে। আর্থিক বা অর্থনৈতিকভাবে লাভবানহতে পারেনি দেশটি। উল্টো বৈদেশিক ঋণেরবোঝা বেড়ে আমদানিনির্ভর দেশটির রিজার্ভথেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতিতে চাপপড়েছে। দেউলিয়া হয়ে পড়েছে শ্রীলংকা।

রাজাপাকসেদের গৃহীত উচ্চাভিলাষী শ্বেতহস্তীপ্রকল্পগুলোর অন্যতম হলো তাদের নিজজেলা হাম্বানটোটার মাত্তালা রাজাপাকসেইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। দীর্ঘ রানওয়ে, সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষিত কর্মী থেকে শুরুকরে একটি আধুনিক বিমানবন্দরের যা যাপ্রয়োজন, তার সবই আছে এতে। নেই শুধুযাত্রী। বিমানবন্দরটির ব্যস্ততম দিনেও ১০০জন যাত্রী পার হয় না। কোনো কোনো দিনকোনো যাত্রীরই দেখা মেলে না।বিমানবন্দরটিতে ফ্লাইট পরিচালনাকারীআন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস মোটে একটি—ফ্লাইদুবাই। অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটও মোটেএকটি—স্থানীয় সিনামন এয়ার পরিচালিতমাত্তালা-কলম্বো ফ্লাইট।

শ্রীলংকা সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ২১কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছেবিমানবন্দরটি। এর মধ্যে ১৯ কোটি ডলারঅর্থায়ন করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। কোনোকোনো সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিমানবন্দরটিনির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৭ কোটি ২০ লাখডলার। এর মধ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণ২৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

জঙ্গুলে এক দুর্গম অঞ্চলে গড়ে তোলাহয়েছে বিমানবন্দরটি। অঞ্চলটির লোকসংখ্যাওমোটে ২৩ হাজার। বর্তমানে বিমানবন্দরটিররানওয়েতে বন্য হাতির পাল ঘুরে বেড়াতেদেখা যায়। বিমানবন্দরের সংযোগ সড়কটিকেস্থানীয়রা ব্যবহার করছেন গোলমরিচশুকানোর স্থান হিসেবে।

বিমানবন্দরের অদূরে গড়ে তোলা হয়েছেমাহিন্দা রাজাপাকসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটস্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটির আসনসংখ্যা ৩৫হাজার। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটেরম্যাচ আয়োজনের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলাস্টেডিয়ামটিতে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচআয়োজন হয়েছে খুব কমই। লংকা প্রিমিয়ারলিগের কিছু ম্যাচ আয়োজন হলেও এরসংখ্যাও হাতে গোনা। এছাড়া মাঝেমধ্যেস্থানীয়দের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ভাড়া দেয়া হয়স্টেডিয়ামটি।

দুর্গম জনবিরল অঞ্চলটিতে বিপুল পরিমাণব্যয়ে এ স্টেডিয়াম নির্মাণের সিদ্ধান্ত শুরুথেকেই বেশ সমালোচিত হয়েছে। এমনকি এটিনির্মাণে প্রকৃত ব্যয় কত সেটি নিয়েও অনেকবিতর্ক রয়েছে। এসব বিতর্কের প্রতিটিতেইসমালোচকদের অনুসিদ্ধান্ত হলো স্টেডিয়ামটিনির্মাণে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাত্কৃত অর্থেরপরিমাণ এর প্রকৃত ব্যয়ের চেয়েও অনেকবেশি।

বিশ্লেষকদের মতে, হাম্বানটোটার শ্বেতহস্তীপ্রকল্পগুলো হাতে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটামালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের উন্নয়ননীতি ‘গড়ে তুললেই মানুষ আসবে’ অনুসরণকরেছিলেন রাজাপাকসেরা। কিন্তু মাত্তালারক্ষেত্রে এ নীতি কাজে আসেনি। অঞ্চলটিকেওপর্যটকদের জন্য তেমন একটা আকর্ষণীয় করাযায়নি।

হাম্বানটোটা অঞ্চলের সবচেয়ে বিতর্কিতপ্রকল্প হলো হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।মাহিন্দা রাজাপাকসের আগ্রহে ২০০৮ সালেবন্দরটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। বন্দরটি নির্মাণেব্যয় হয় ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীনেরঋণ ছিল ১৩০ কোটি ডলার। চায়না হারবারইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও সিনো হাইড্রোকরপোরেশনের জয়েন্ট ভেঞ্চারে নির্মিতপ্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয় ২০১২সালে। পুরোপুরি শেষ হয় ২০১৫ সালে।২০১৬ সালে বন্দরটির মালিকানা পায়শ্রীলংকা পোর্ট অথরিটি (এসএলপিএ)। ২০১৬সালে প্রথম বছরেই ৪ হাজার ৬৭০ কোটিরুপি লোকসান দেয় বন্দরটি। যদিও ২০৩৬সালের মধ্যে বন্দরটির জন্য চীনকে ঋণেরসুদ ও আসলসহ মোট ১৭০ কোটি ডলারপরিশোধ করার কথা শ্রীলংকার। সুদ-আসলমিলিয়ে প্রতি বছর শুধু বন্দরটির জন্যইচীনকে প্রায় ১০ কোটি ডলার করে পরিশোধকরতে হবে শ্রীলংকাকে। একপর্যায়ে বোঝাযায়, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে ঋণ শোধকরা হলেও বন্দরটি আর্থিকভাবে পুরোমাত্রায়লোকসানি। এ ঋণের বোঝা কমাতে গিয়ে২০১৭ সালে বন্দরটি চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে দেয় রনিলবিক্রমাসিংহের সরকার।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *