সিলেট পাসপোর্ট অফিস যেনো দালালদের স্বর্গরাজ্য। এ অভিযোগ নতুন না। অনেক পুরানো। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে প্রিন্ট এবং অনলাইন গণমাধ্যমে। প্রচুর সংবাদ প্রচার হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলেও। কিন্তু অনিয়ম আর দুর্নীতির জগদ্দল পাথর যেভাবে চেপে বসেছে সিলেটবাসীর বুকে, তা থেকে আর নিস্তার মিলছেই না।
তবে এবার আশায় বুক বাঁধছেন সচেতন মহল। সিলেটের দুর্ণীতি দমন কমিশনের নজর পড়েছে এই প্রতিষ্ঠানের উপর। পাসপোর্ট অফিসের সার্বিক কর্ম পরিবেশ, বিশেষ করে দালালদের দৌরাত্ম্ব বন্ধ করে একটা জনবান্ধব পাসপোর্ট অফিস উপহার দিতে তারা কাজ শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সিলেট পাসপোর্ট অফিস আর দুর্নীতি প্রায় সমার্থক শব্দে পরিণত বহু বছর ধরে। পাসপোর্টের ফাইল জমা, ভুল সংশোধন, ডেলিভারি- ইত্যাদি প্রায় সবধরণের সেবার ক্ষেত্রেই সেবা প্রার্থীদের দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হওয়া নিত্য-নৈমিত্তক ব্যাপার।
একদিন বা দু’দিন নয়, এসব সেবার যেকোন একটির জন্য একজন গ্রাহককে প্রচুর ছুটাছুটি করতে হয়। কিন্তু এতেও কাজ আদায় বলতে গেলে হয়ই না। যতক্ষণ কোন দালালের সাহায্য নিচ্ছেন না, ততদিন কাজটি ঝুলেই থাকে, তা সেই কাজ যত ছোটো হোক বা বড় হোক, দালাল ছাড়া গত্যন্তর নেই।
নতুন পাসপোর্ট তৈরি বা নবায়ন, যাই হোকনা কেন দালাল ছাড়া নিজে নিজেই ফাইল জমা দিতে গেলে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে আপনার দফা রফা হওয়ার উপক্রম হবে, কিন্তু কোন লাভ হবেনা। একেকদিন লাইনে থাকেন ৪/৫শ’ মানুষ। এত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন অনেক দালাল এসে ফিসফাস করে নানা ধরনের ভীতি ছড়িয়ে দেয়। তাদের দৌরাত্ম্য এমনই যে, প্রায়ই সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা খটমট লেগেই থাকে। এমনকি মাঝে মাঝে হামলার ঘটনাও সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে। দালালদের আশ্রয় বা সাহায্য নিলে সহজেই কাজগুলো হয়ে যায়। তবে এজন গ্রহকদের গুনতে হয় ৮শ’ থেকে হাজার টাকার বেশি।
এসব দালাল আবার নানা কাজের কাজি। তাদের কাছে ছবি বা কাগজপত্র সত্যায়নের সিল-প্যাডও থাকে। নিজেরাই নিজের গ্রাহকের কাগজপত্র সত্যায়িত করে দেন। ফি নেন উচ্চ হারে। অফিসের বড় কর্তারাও এসব বিষয়ে কোন প্রশ্ন তুলেন না। তবে কোন গ্রাহক নিজে কাগজপত্র জমা দিলে তাকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয়। কিন্তু তারপরও ফাইল জমা নেয়া হয়না নানা অজুহাতে।
বিশ্বনাথের মাসুদ আহমদ ( ২৭) এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, তার ভাইয়ের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পাসপোর্টের কোন খবর নাই। অথচ সরকারি নিয়মানুসারেই আমি আবেদন করেছি।
এছাড়াও আছে অসাধু ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা। তাদের নির্ধারিত কোড নম্বর ফাইলে না থাকলে সেটি আর গ্রহণ করা হয় না। এমন অভিযোগও আছে অসংখ্য।
সিলেট পাসপোর্ট অফিসের এসব পুরানো অভিযোগ নিয়ে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন সিলেট অফিসের একটি দল পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালায়। অভিযানের পর দুদক জানিয়েছিল, সিলেটে কিছু ট্রাভেলস ব্যবসায়ীর যোগসাজশে দালাল চক্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। কিন্তু এরপর তারা নিরব হয়ে যায়। আর কোন অগ্রগতি জানা যায়নি।
তবে এখন আবার তারা সরব হয়েছে। বৃহস্পতিবার ( ৮ সেপ্টেম্বর ) দুর্ণীতি দমন কমিশন সিলেট বিভাগীয় শাখার একটি দল সিলেট পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়েছে। কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের এই অভিযান।
অভিযানে ছিলেন, এমন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমাদের কাছে আসা অভিযোগের কোন কোনটির সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে তাৎক্ষনিক কোন জরিমানা বা কারো কোন শাস্তি ঘোষণা হয়নি। এ অভিযানের রিপোর্ট জমা দেয়া হবে। এরপর আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন সিলেট শাখার উপপরিচালক নূরে আলম সিলেট প্রতিদিনের সাথে আলাপকালে বলেন, সিলেট পাসপোর্ট অফিস নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। প্রচুর অভিযোগ আছে। সেরকম কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার দুদকের একটি টিম পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়েছে। এই রিপোর্ট ঢাকায় পাঠানো হবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা আইনী পদক্ষেপ নিবো।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে নূরে আলম বলেন, সিলেট পাসপোর্ট অফিস এলাকা যাতে আরও বেশি জনবান্ধব ও গ্রাহক বান্ধব হয়, এ ব্যাপারে দুদকের পক্ষে যেটুকু করনীয় আছে, আমরা অবশ্যই তা করবো।
শেয়ার করুন