সিলেটে গণপরিবহন বলতে সিএনজি অটোরিকশাকেই বোঝায়। এর বাইরে এখনো তেমন কোনো প্ল্যাটফরম গড়ে উঠেনি। সিলেট সিটি করপোরেশন চেয়েছিল যাত্রীবাহী বাসকেন্দ্রিক গণপরিবহন চালাতে। সেটি চালিয়েছিলও।
কিন্তু সেই প্রক্রিয়াও কোনো ফলাফল আসেনি। এ কারণে সিএনজি অটোরিকশা নির্ভরই সিলেটের মানুষ। কিন্তু দিনে দিনে অটোরিকশাগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসনও। সিলেটে বৈধ সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ১৯ হাজার ২৩২।
বাস্তবে নগর এবং জেলায় চলছে এর দ্বিগুণ। বৈধের চেয়ে এখন অবৈধের সংখ্যা বেশি। বিআরটিএ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত সিএনজি অটোরিকশা যথেষ্ট বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। ২০১৪ সাল থেকে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে সিলেটের সড়কে চলাচলের জন্য নতুন কোনো সিএনজি অটোরিকশার বৈধতা দেয়নি। এরপরও শো-রুম থেকে সিএনজি বিক্রি কমেনি। বর্তমানে শো-রুম থেকে কেনা অনটেস্ট অটোরিকশার সংখ্যা ৫ থেকে ৭ হাজারের কাছাকাছি। যেগুলো কোনো বৈধতা ছাড়াই গত ১১ বছর ধরে সিলেটের সড়কে চলছে। এ ছাড়া চোরাই ও অন্য জেলার মিলিয়ে গাড়ির সংখ্যা হবে ১০ থেকে ১২ হাজার।
এসব সিএনজি অটোরিকশা চলার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য। সেগুলো পরিচালনা করছেন সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক আলতাফ, আজমল, ওয়ারিছসহ কয়েকজনের সিন্ডিকেট। মাসে এক হাজার টাকা করে টোকেন নিয়ে এসব সিএনজি অটোরিকশা সড়কে চলেছে। বছরে টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ৫ই আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সিলেটে টোকেন বাণিজ্য নিয়ে হুলস্থুল পড়ে। শ্রমিক নেতাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডে যখন পুলিশ বিতর্কিত হয় তখন বিষয়টি নজরে আসে পুলিশ কমিশনার মো. রেজাউল করিমের।
তিনি ট্রাফিক বিভাগকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন। ট্রাফিক বিভাগ থেকে ১৫ জনের মধ্যে কর্মকর্তা ও সদস্যদের বদলি করে সেখানে নতুন করে সেটআপ করেন। এই সেটাপে ট্রাফিক পুলিশের ডিসি’র নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন দক্ষিণের ডিসি মাহফুজুর রহমান। তিনি আগেও সিলেট মেট্রো পুলিশে ট্রাফিকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি এসে ট্রাফিক বিভাগে পুলিশের দুর্নাম ঘোচাতে কাজ শুরু করেছেন। অনটেস্ট, চোরাই ও সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে চালাচ্ছেন সাঁড়াশি অভিযান। এ অভিযানে ইতিমধ্যে কয়েকশ’ গাড়ি আটকানো হয়েছে।
টোকেন বাণিজ্যে আনা হয়েছে জিরো টলারেন্স নীতি। এতে ক্ষেপেছে অনটেস্ট সিএনজি অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্যের সুবিধাভোগীরা। পুলিশকে টক্কর দিতে তারা ইতিমধ্যে গঠন করেছে অনটেস্ট সিএনজি অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এই পরিষদের আহ্বানে নগরের চন্ডিপুল এলাকায় সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। এই সমাবেশকে ঘিরে সিলেটে কৌতুহল দেখা দিয়েছে। এ সমাবেশের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে সিলেট জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এ সমাবেশে যোগ দেবেন। অনটেস্ট সিএনজি অটোরিকশার বৈধতার বিষয়ে তারা আন্দোলনে ছিলেন, আছেন এবং আগামীতে থাকবেন।
তিনি জানিয়েছেন- ‘সিলেটে চলমান চোরাই ও রোহিঙ্গা গাড়ি আটক নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। এসব গাড়ি এখন গলার কাঁটা। তবে অনটেস্ট গাড়ি চালানোর দাবি যৌক্তিক। এ কারণে এতে আমরা অংশ নিচ্ছি।’ সিলেটে অনটেস্ট, চোরাই ও রোহিঙ্গা গাড়ি যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তারা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। তাদের দিয়ে সিলেটের সড়কে গাড়ি চলছে। স্ট্যান্ডের সংখ্যাও বেশি।
নগরের শেখঘাটের জিতু মিয়ার পয়েন্টে একসঙ্গে তিনটি স্ট্যান্ড। প্রতিটি স্ট্যান্ডে গাড়ি থাকছে। নগরের যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে সিএনজির অবৈধ স্ট্যান্ড। কোর্ট পয়েন্টে একসঙ্গে ৪ থেকে ৫টি স্ট্যান্ড। এসব নিয়ে সিলেট নগর কর্তৃপক্ষ, পুলিশ প্রশাসনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বার বার উদ্যোগ নেয়া হলেও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অসহযোগিতা করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শ্রমিকরা একাধিক বার মুখোমুখি হয়েছে। এদিকে, সিলেটে অটোরিকশার সার্বিক অব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ।
বর্তমানে তারা যে অভিযানে রয়েছে সেখানে অনটেস্ট গাড়িকে জরিমানা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হলে চোরাই ও রোহিঙ্গা গাড়ি আটক করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ট্রাফিক বিভাগ কঠোর বলে জানিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি ট্রাফিক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন- যারা অনটেস্ট গাড়ির মালিক ও শ্রমিক তারা গাড়ি চালানোর জন্য আন্দোলন করাটা কতোটুকু যৌক্তিক সেটা প্রশ্ন রাখে। তবে পুলিশ টোকেন বাণিজ্য, অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধে কঠোর রয়েছে। অনুমোদন নিয়ে গাড়ি চালালে পুলিশ সবাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
তিনি বলেন- সিলেট নগরে থ্রিহুইলার সিএনজি অটোরিকশার জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন। নীতিমালা না থাকার কারণে কার্যত কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। নীতিমালা নিয়ে কাজ করার জন্য গত বছর মেট্রো ট্রাফিক বিভাগ থেকে বিআরটিএকে একটি পত্র দেয়া হয়েছে। তার মতে- অনটেস্ট, চোরাই ও অন্য জেলার গাড়ি সড়ক থেকে সরিয়ে নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। পাশাপাশি আনফিট সিএনজি অটোরিকশা কমালে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এরপর নতুন করে নীতিমালা অনুসরণ করে অনুমোদনের বিষয়টি দেখা যেতে পারে।
শেয়ার করুন