বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দামে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। বিশ্ববাজারে অনেক আগে থেকেই দাম কমার পর দেশের বাজারেও কিছুটা কমানোর ঘোষণা দেয় সরকার। তবে এর প্রভাব নেই বাজারে। ভোজ্য তেল নিয়ে এখনও কারসাজি করছেন সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ানোর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তা কার্যকর করলেও কমানোর ঘোষণা কার্যকর হচ্ছে না এক সপ্তাহেও। বিশ্ববাজার অনুযায়ী দেশে এখন সয়াবিনের লিটার ১২৪ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পর ১৮৫ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন আমদানিকারকরা। বাস্তবে এ দামেও বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ভোজ্য তেল আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারের সুফলও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এর পুরো সুবিধা নিচ্ছেন আমদানিকারকরা।
পণ্যটি আমদানিতে রেয়াতি ভ্যাট সুবিধা আরও ৩ মাস অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এসব সুবিধা নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানি করছেন বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকরা। এতে দাম পড়ছে কম। এদিকে দুই মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সয়াবিনের দাম ৩২ শতাংশ এবং পাম-অয়েলের দাম ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে হাজার কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
উল্লেখ্য, গত ১৭ই জুলাই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে ১৮৫ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়। এই দাম ১৮ই জুলাই থেকেই পাইকারি বা খুচরা সব বাজারে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। যদিও বাজারে নতুন তেল আসেনি দাবি করে আগের দামেই তেল বিক্রি করছেন দোকানিরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ টন, বাকি ১৮ লাখ টনই আমদানি করতে হয়।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী ফসলের উৎপাদন হয় মাত্র ৩ লাখ টন। যা চাহিদার শতকরা ১২ ভাগ। বাকি ভোজ্য তেল আমদানি করতে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে তেল আমদানিতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় আর এ বছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
তেলের বাড়তি দাম নিয়ে গত কয়েক দিনে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, প্রতিদিনের ভোজ্য তেলের চাহিদার সঙ্গে তুলনা করে তারা অনুমানিক এই পরিসংখ্যান পেয়েছেন। প্রতিদিন যদি ৫০০০ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা থাকে, তাতে লিটারে ১৪ টাকা করে ধরলে এই অঙ্কটা আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পাম তেল এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন আমদানি হয়েছে। মোট ২১ লাখ ৩৫ হাজার টন ভোজ্য তেল আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। দাম বাড়ায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি করতে হয়েছে।
সিলেটে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিগুলো যে বোতলজাত তেল সরবরাহ করেছে তাতেও আগের দরই লেখা ছিল। অথচ এর আগে দাম বাড়ালে তারা দ্রুতই বাড়তি দর লেখা তেল সরবরাহ করতো। কিন্তু এবার দাম কমানোর ঘোষণার সপ্তাহ খানেক পার হলেও এখনো সব বাজারে নতুন দরের তেল সরবরাহ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভেজাল কমাতে আগামী ৩১শে জুলাই থেকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ হচ্ছে। খোলা পাম অয়েল বিক্রি বন্ধ হবে ৩১শে ডিসেম্বর থেকে। এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চাহিদা বাড়বে। সূত্রটি বলেছে, খোলা তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেলে প্যাকেটজাত তেলের দাম ২ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাই একটি অসাধু চক্র নতুন দরের বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহে গড়িমসি করছে।
বিশ্ববাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর সয়াবিন তেলের বার্ষিক গড় দাম আগের বছরের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছিল। প্রতি টনের মূল্য ৮৩৮ থেকে ১৩৮৫ ডলারে উন্নীত হয়। আর মার্চে ১৯৬৫ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এপ্রিলে দাম বেড়ে ২১০০ ডলারে উঠেছিল। এরপর জুন থেকে দাম কমতে শুরু করে। চলতি জুলাইয়ে দামের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বিশ্ববাজারে বর্তমানে ১৩২০ থেকে ১৩৫০ ডলারে লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু দেশের বাজারে তেলের দাম সে অর্থে কমছে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দুই মাসের ব্যবধানে কমেছে ৩২ শতাংশ। বর্তমান দর অনুসারে লিটার প্রতি সয়াবিনের দাম ১২৪ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম ৭১ টাকা। অথচ দেশের বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন লিটার প্রতি ১৯৫ এবং খোলা পাম ১৫৫ টাকা।
কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব)’র সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়তি ছিল তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে এলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দাম কমলেও সে অনুপাতে কমানো হয়নি। তাই ক্রেতারা এর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে দাম কমেছে সেটা সত্য। সে অনুপাতে দেশের বাজারেও কমানো হচ্ছে। কিন্তু যে হারে কমছে সে হারে কমানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এই দামের সঙ্গে জাহাজ ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হয়। পাশাপাশি বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে চড়া দাম থাকার সময় খোলা হয়েছে, যা এখন বাজারের সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতন হচ্ছে। সেসব তেল দেশে আসতে দেড় মাস সময় লাগবে। হয়তো তখন দাম সমন্বয় করে বিক্রি হবে।
সিলেটের আম্বরখানা বাজারের মো. সোহেল বলেন, বাজারে তেলের দাম কমেছে শুনেছি, কিন্তু নতুন দামের তেল এখনো দোকানে আসেনি। গত দুদিন আগেও তেল আগের রেটে কিনে রাখতে হয়েছে। বোতলের গায়ে রেট ১৯৯ টাকা। আমাদের আগের রেটে কেনা তাই আগের রেটেই বিক্রি করতে হচ্ছে। কাওরান বাজারের ফ্রেশ কোম্পানির তেলের ডিলার আঁখি এন্টারপ্রাইজের নিজাম উদ্দিন দিপু বলেন, আমাদের এখানে অধিকাংশ তেলের কার্টনই আগের মূল্যের কিন্তু আমরা বর্তমান মূল্যেই বাজারে দিচ্ছি। শুধুমাত্র ৫ লিটারের তেলের নতুন কার্টন এসেছে। ফ্রেশ কোম্পানির সয়াবিন তেল পাইকারি ৫ লিটারের বোতল ৮৮০ টাকা, ২ লিটার ৩৬২ টাকা, ১ লিটার ১৮১ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বাংলাদেশে প্রতি মাসিক ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় দেড় লাখ টন। অন্যদিকে সাধারণ সময়ে দৈনিক ৫ হাজার টন তেলের প্রয়োজন হয়ে থাকে এবং রমজান মাসে ৮ হাজার টন তেলের চাহিদা থাকে। নির্ধারিত মূল্যের তেল বাজারে না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। কয়েকটি বাজারে ইতিমধ্যে নতুন মূল্যের তেল চলে এসেছে। আমরা কোম্পানিগুলোকে মোটিভেশন করার চেষ্টা করছি। একটি কোম্পানি আগের মূল্যের ২৩৮ টন তেল বাজারে ছাড়তে চেয়েছিল। আমাদের টিম যেয়ে তাদেরকে আগের মূল্যের তেল ছাড়তে নিষেধ করেছে। এজন্য তারা সেটা বন্ধ করে নতুন মূল্যের তেল বাজারে ছেড়েছে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, দোকানগুলোতে হয়তো এখনো আগের মূল্যের কিছু তেল মজুত রয়েছে। সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে নতুন মূল্যের তেল বিক্রি শুরু হবে। দুইদিনের মধ্যেই বাজারে নতুন দামের তেল পাওয়া যেতে পারে। তেলের দাম আরও কমানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম আরও কমানো হবে।