দেশজুড়ে শুরু হয়েছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা। তার ওপর তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। লোডশেডিং এবং গরমের হাত থেকে বাঁচতে চার্জিং লাইট ও ফ্যানের দোকানে ভিড় করছে মানুষ। আর এ সুযোগে লাইট, ফ্যানসহ ব্যাটারির দামও বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। নিরুপায় হয়ে বাড়তি দামেই এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে তারাও একটু বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন।
সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারস্থ সবুজ বিপণী, বন্দরবাজারের ওরিয়েন্টাল সপিং সিটিসহ কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি চার্জার লাইটে ১শ থেকে দেড়শ টাকা, চার্জার ফ্যানে ১২শ টাকা, কুলার ফ্যানে ৩ হাজার টাকা, ফ্যানের ব্যাটারিতে ৪শ টাকা, আইপিএসে ৯ হাজার টাকা ও আইপিএসের ডিস্টিল্ড ওয়াটার (ব্যাটারির পানি) ২০ টাকা বেড়ে গেছে।
চায়নার তৈরি চার্জার ফ্যান ১২শ টাকা বেড়ে ৪২শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশিয় ব্র্যান্ড ওয়ালটনের তৈরি টেবিল ফ্যানে এক হাজার টাকা বেড়ে মানভেদে সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ওয়ালটনের স্ট্যান্ডসহ চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে ৪৮শ টাকায়। পণ্যটি একমাস আগেও সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে কুলার ফ্যানে আড়াই হাজার টাকা বেড়ে সাড়ে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগে তিন হাজার ভিএসি মডেলের আইপিএস ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৩৯ হাজার থেকে ৩৯ হাজার ৯শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২শ’ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া চায়নার তৈরি চার্জার লাইট এখন ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দর হাকছেন বিক্রেতারা। পাশাপাশি বেড়েছে ব্যাটারির দামও। ফ্যানের ব্যাটারিতে ৪শ’ টাকা বেড়ে ৯শ’ টাকা ও আইপিএসে ব্যবহৃত ডিস্টিল্ড ওয়াটার আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অধিকাংশ চার্জার লাইট, ফ্যান ও ব্যাটারি জাতীয় পণ্যগুলো চায়না থেকে আমদানি হয়। তবে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ফ্যানের চাহিদাও কম নয়। সারাবছরের মধ্যে শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে বেচাবিক্রি বেশি হয়। বছরের অন্যান্য সময় চার ভাগের দুই ভাগও ব্যবসা হয় না। বছরের চাহিদা বিবেচনায় এনেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে এবছর তুলনামূলক কম পণ্য আমদানি করেন তারা। তবে নগরজুড়ে আগের চেয়ে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়ায় হঠাৎ করেই এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই চাহিদার তুলনায় যোগান কম থাকায় দামটাও তুলনামূলক বেড়েছে।
এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং সঙ্গে তীব্র দাবদাহের কারণে শুধু চার্জার ফ্যান বা লাইট নয়, চাহিদা বেড়েছে জেনারেটরেরও। বিক্রির পাশাপাশি অনেকেই মেরামত করিয়ে নিচ্ছেন ঘরে পড়ে থাকা পুরনো জেনারেটর।
সবুজ বিপণীতে চার্জার ফ্যান কিনতে আসা নগরীর বনকলাপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আবদুল করিম বলেন, ‘সোমবার ঘোষণার পর লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাসায় ছোট বাচ্চারা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। সেজন্য ব্যাকআপ লাইট ও চার্জিং ফ্যান কিনেছি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দোকানদাররা এগুলোর দামও বাড়িয়েছে। যে ফ্যানের দাম জেনে এসেছি ২৫ থেকে ২৭ শ’ টাকা, সেই ফ্যানের দাম এখন চাওয়া হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।’
কথা হয়- নষ্ট চার্জিং ফ্যান ঠিক করতে আসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এমদাদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই লোডশেডিং ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ঘরবন্দী জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। সঙ্গে ইলেকট্রনিক ডিভাইসয়ের দামও তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেজন্য বাসায় অনেক দিন ধরে নষ্ট চার্জিং ফ্যানটা ঠিক করাতে আনলাম। এটা ঠিক করালে কোনোভাবে আমাদের চলে যাবে। তাই ঠিক করাতে এনেছি।’
কাদির নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘দুইমাস আগে যে পাকিস্তানি ফ্যান ৫ হাজার টাকায় কিনেছিলাম, সেটি এখন ৬ হাজার টাকার উপরে। এমনভাবে ফ্যানের দাম বাড়ায় আমরা ক্রেতাসাধারণরা বিপাকে পড়েছি।’
ওরিয়েন্টাল শপিং সিটিতে রিচার্জেবল ফ্যান কিনতে আসা কুমারপাড়ার সোহাগ আহমদ বলেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে বাসার বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি সমস্যা হচ্ছে। গরমের মধ্যে তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে রিচার্জেবল ফ্যান কিনতে আসলাম। তবে এসে দেখি ফ্যানের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এখন যে পরিস্থিতি দাম বাড়লেও পরিবারের প্রয়োজনের তাগিদে কিনতে হবে।’
শাপলাবাগ থেকে আসা গৃহিনী রহিমা বেগম বলেন, ‘আমার বাচ্চার বয়স চার বছর। সে এখন স্কুলে যাচ্ছে। তার জন্য একটি রিচার্জেবল ফ্যান ও লাইট কিনতে আসলাম। সন্ধ্যায় বাচ্চাটা একটু পড়তে বসে সেসময়ের জন্য লাইট ও ফ্যানের দরকার হয়। তাই একটি ফ্যান ও লাইট কিনবো। কিন্তু যে দাম চাওয়া হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে- ফ্যান ও লাইট দাম কেনা হবে না।’
ওরিয়েন্টাল শপিং সিটির মোবারক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে চার্জার ফ্যান ও চার্জার লাইটের চাহিদা বেড়েছে। ফলে নগদ টাকা দিয়েও পাইকারি বাজারে চার্জার ফ্যান পাচ্ছি না।’
আগের তুলনায় ফ্যানের দাম প্রায় অর্ধেক বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে যে ফ্যান ২৬শ’ টাকায় বিক্রি করতাম এখন সেট ৩২-৩৩ শ’ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ আগের তুলনায় ফ্যানের দাম বেড়েছে। আর প্রতিটি চার্জার লাইটের দাম বেড়েছে ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত।’
সবুজ বিপণীর পাইকারি ইলেক্ট্রনিক্সসামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান রাফি ইলেকট্রনিক’র মালিক শাকিল আহমদ বলেন, ‘এসব পণ্য মূলতঃ ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাদের সিলেটে বিদেশ থেকে মালামাল আমদানি করা হয় না। ফলে ঢাকার পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে আমাদের পণ্য ক্রয় করতে হয়। আর এসব সামগ্রী সিলেটে নিয়ে আসতে পণ্য পরিবহন খরচ লাগে। তাছাড়া গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্যানের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য। তবে আমরা সামান্য লাভেই পাইকারি বা খুচরো বিক্রি করি।’
এদিকে, লোডশেডিং আর বন্যার প্রভাবে সিলেটে জেনারেটরের চাহিদাও বেড়েছে। অনেকেই নতুন জেনারেটর ক্রয় করছেন, আবার অনেকেই পুরাতন জেনারেটর মেরামত করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে জেনারেটর বিক্রয়কারী ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানেও ভিড় বেড়েছে। এ সুযোগে নতুন জেনারেটর ক্রয় করতে ও অকেজো জেনারেটর সচল করতে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। তারা বলছেন- সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের পকেট কাটছেন।
নগরীর বারুতখানা পয়েন্ট সংলগ্ন পপুলার অটো ওয়ার্কশপ-এর জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ মাহফুজ আলী (রাহেল) বলেন, ‘আসলে লোডশেডিং আর ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জেনারেটরের দাম ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমরা আমাদের ক্রেতাদের কাছ থেকে পূর্বের দামে জেনারেটর বিক্রি করছি। এছাড়া যারা অকেজো জেনারেটর মেরামত করতে এসেছেন তাদের কাছ থেকে অনেক সময় আগের তুলনায় কম টাকা মজুরি নিচ্ছি।’
শেয়ার করুন