মজুতের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ৩টি-ই সিলেট বিভাগে। সেগুলো হচ্ছে- সিলেটের গোলাপগঞ্জের কৈলাসটিলা, হবিগঞ্জের রশিদপুর ও বিবিয়ানা।
এর মধ্যে বিবিয়ানা ছাড়া বাকি দুটি গ্যাসক্ষেত্রে কমেছে উৎপাদন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার না হওয়ায় মজুত থাকার পরও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এর জন্য মূলত জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা দায়ী।
দেশে বর্তমানে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মজুতের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি গ্যাসক্ষেত্রের ৩টি-ই সিলেটে। সিলেটের কৈলাসটিলা ও হবিগঞ্জের রশিদপুর থেকে গ্যাস উৎপাদন করে সরকারি কোম্পানি সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড (এসজিএফএল)। আর হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে গ্যাস উৎপাদন করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। দেশে দৈনিক উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি আসে এই সিলেট বিভাগের ৩টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে!
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও গ্যাস উৎপাদনকারী ওই চারটি কোম্পানি সূত্র বলছে, এই ৩টির মধ্যে সবচেয়ে কম মজুত নিয়ে কয়েক গুণ বেশি উৎপাদন করছে বিবিয়ানা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে ওই সময়কার কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিবিয়ানায় সব আধুনিক প্রযুক্তি। উৎপাদনের হার বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকটি ভাবা হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে বেশি করে উন্নয়ন কূপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে বেশি হারে উৎপাদন করে গ্যাসের মজুত দ্রুত শেষ হতে পারে, এটিও চিন্তা করা হচ্ছে।
বর্তমান মজুতের হিসাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র সিলেটের কৈলাসটিলা থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৭৮৮ বিসিএফ। আর মজুত আছে ১ হাজার ৯৭০ বিসিএফ। দিনে উৎপাদন করা হচ্ছে মাত্র ৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট। আর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৬৮৩ বিসিএফ গ্যাস। মজুত আছে ১ হাজার ৭৫০ বিসিএফ। দিনে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এসজিএফএল সূত্র বলছে, ওই দুটি গ্যাসক্ষেত্রের আটটি কূপ থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। আরও পাঁচ থেকে ছয়টি কূপ খনন করতে পারলে এখানে উৎপাদন বাড়ানো যেত।
এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, কৈলাসটিলায় একটি কূপ খননের কাজ আগামী বছরের মার্চে শুরু হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি এই কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় আটটি নতুন কূপ খনন করা হবে।
এদিকে, গ্যাসের মজুতের দিক থেকে চতুর্থ হলেও উৎপাদনে শীর্ষে আছে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। দিনে এখানে উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৭টি কূপ থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ১ হাজার ২৩৫ ঘনফুটের বেশি। দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের অর্ধেক আসে এখান থেকে। উৎপাদন বাড়াতে গত বছর গ্যাস উত্তোলনের পাইপ পরিবর্তন করে বেশি ব্যাসার্ধের পাইপ বসিয়েছে তারা। বর্তমানে এ গ্যাসক্ষেত্রে মজুত আছে ৭৬৪ বিসিএফ গ্যাস।
তবে সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন নিয়ে বিবিয়ানার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গত ২ এপ্রিল মধ্যরাতের পর বিবিয়ানার গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের দুটি ইউনিটে বালু উঠে আসে। বালুর উৎস শনাক্ত করতে না পারায় ছয়টি কূপের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। পরে এটি ধীরে ধীরে চালু করা হয়েছে। বেশি উৎপাদনের কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁরা সতর্কও করেছেন।
গ্যাস খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কূপ খননের কাজ আরও বেগবান হলে উৎপাদন বাড়ত। বিবিয়ানার প্রযুক্তি ভালো। গ্যাসের প্রবাহও ভালো সেখানে। এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আবার পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেশি উত্তোলন করতে গেলে সমস্যাও হতে পারে। তবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যত জোর দেওয়া যায়, ততই ভালো।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে শুরু থেকেই দেশীয় কোম্পানির কারিগরি পরিকল্পনা ছিল না। খাপছাড়া কূপ করে উৎপাদন করে গেছে। সময়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করেনি। দেশের গ্যাস উৎপাদনে কারিগরি দুর্বলতাও আছে। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা হলেও তাদের সুপারিশ মানেনি পেট্রোবাংলা। এর জন্য মূলত জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা দায়ী।
শেয়ার করুন