
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এসেছে, যার প্রভাব আজও বিস্তৃত রয়েছে দেশের রাজপথ থেকে সরকার, মিডিয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি অজোপাড়ার অলিগলি পর্যন্ত। বিগত ১৭বছরে বিরোধী দলগুলোর ওপর ধারাবাহিক দমন, গ্রেফতার, গুম-খুন আর অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এসব কিছু মিলে বাংলাদেশ এক চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা চাপের মুখোমুখি পড়েছিল। এই সময়টিকে বোঝার জন্য শুধু পত্রিকার শিরোনাম নয়, মানুষের মুখের ভাষা, কান্না, ক্ষোভ এবং কষ্টকেই পাঠ করতে হবে। কেননা, জুলাই যেন একটি জলবিভাজিকা- যেখান থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবেক নতুন করে পরখ করা শুরু হয়েছে। হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিয়োগে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। কিন্তু আজ প্রশ্ন হচ্ছে, এই রক্ত, এই বিনিয়োগের রিটার্ন কী? আমরা কি সত্যিই পেয়েছি সেই নতুন বাংলাদেশ, যেখানে বৈষম্য, ন্যায়বিচার, সমতা, গণতন্ত্র এবং মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত? নাকি ক্ষমতার স্বার্থে গড়ে ওঠা এক ভংগুর, দখলদার বাংলাদেশ। যেখানে রক্তপাত শুধু পোস্টারে আঁকা ছবি আর ত্যাগ কেবল ইতিহাসের পাতা?
চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগ। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার একজন ছোট ব্যবসায়ী। একজন যুবদল কর্মী, পরিবারের দায়িত্ব নেয়া একজন যুবক। যার জীবন শেষ হলো এমন এক নৃশংসতার মধ্যে দিয়ে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তাকে রাস্তার মাঝে ফেলে উলঙ্গ করা হলো। বারবার বিশাল পাথরখন্ডের আঘাতে হত্যা করা হলো এবং তার নিথর দেহের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করা হলো। শত শত পথচারীর সামনে এই ঘটনা ঘটল। কেউ বাধা দিল না। রাষ্ট্রও কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারল না। এটা শুধু একটি হত্যাকান্ড নয়, এটা আমাদের সভ্যতার গালে চপেটাঘাত।
বাংলাদেশের রাজনীতির পান্ডুলিপিতে সহিংসতা যেন একটি চিরন্তন অনুচ্ছেদ হয়ে আছে। যেখানে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে কেবল চরিত্র বদলায়। কিন্তু রক্তপাতের ধারা বদলায় না। শুধু সন্দেহের বশে ২০১২ সালে ঢাকার সদরঘাটে প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রলীগ কর্মীরা চা-পাতি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বজিৎকে। পুরো ঘটনাটি শহরের মাঝখানে ঘটলেও কেউ কিছু করতে পারেনি। কারণ খুনিরা ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সদস্য। এরপর ২০১৯ সালে বুয়েটের হলরুমে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগেরই কর্মীরা। কারণ সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি মতপ্রকাশ করেছিল। এইসব হত্যাকান্ডে শুধু একজনের মৃত্যু হয় না, পুরো সমাজে ভয় ঢুকে যায়। তরুণরা চুপসে যায়, মতপ্রকাশ থেমে যায়। কিন্তু সহিংসতার এই রাজনীতির ফাঁদে কেবল একটি পক্ষই যে আছে তা নয়। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের পর মাত্র একবছরেরই বিএনপির অভ্যন্তরে নেতাকর্মীদের কোন্দল এবং ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে দলটির আভ্যন্তরীণ বীরুধে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৫০ জন কর্মী ও সমর্থক। নিজেদের কর্মীদের হাতে খুন হয়েছেন নিজেদের কর্মীরাই। এই পরিসংখ্যান শুধু ভয়াবহ নয়, এটি একটি অশনি সংকেত। যেখানে রাজনীতি আর মতাদর্শ নয়, বরং অস্ত্র, দম্ভ আর দখলই হয়ে উঠেছে নেতৃত্বের যোগ্যতা। যখন একটি রাজনৈতিক সংগঠন সহিংসতায় ভরে যায় তখন প্রশ্ন ওঠে- এই দেশে রাজনীতি মানুষের জন্য, না মানুষের রক্তে রাজনীতির রঙ বদলের জন্য?
কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র কী করলো? যখন একজন সাধারণ নাগরিক এমন নৃশংসভাবে খুন হচ্ছিলেন তখন রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল তাকে রক্ষা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে কি তা ঘটল? রাষ্ট্র কি সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল? নাকি সে শুধু নিঃশব্দ হয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল?এই প্রশ্নগুলো আমাদের সামনে দায়বদ্ধতার মাপকাঠি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয় তখন শুধু একটি ব্যক্তি নয় সমগ্র সমাজের ওপর বিশ্বাসের ঘাতক হয়। যারা রাষ্ট্রের শীর্ষে থেকে দায়িত্ব পালন করেন তাদের জন্য এই হত্যাকান্ড একটি সরাসরি জবাবদিহির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তারা কি সত্যিই জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারে? যখন রাষ্ট্রের উপস্থিতি শুধু নামমাত্র। তখন সাধারণ মানুষের মনোভাব ভেঙে পড়ে, তাদের বিশ্বাস কমে যায় আর এর ফলশ্রতিতে আইন ও শাসনের শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতাই আরও সহিংসতা, আরও অবিচার সৃষ্টির আহ্বান দেয়। তাই আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, রাষ্ট্রকে জনগণের সেবক ও রক্ষক হিসেবে ফিরিয়ে আনা, যাতে এখন থেকে সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় এবং কেউ নিজের জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় না থাকে।
একজন সাধারণ নাগরিক যখন তার নিরাপত্তার জন্য নিজের ধর্ম, নিজের রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা নিজের দেহকেও আশ্রয় হিসেবে নিতে পারে না তখন বোঝা উচিত যে সমাজের মূল ভিত্তি শেকড়ে পচে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ কেবল নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে না। তার অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে পড়ে। এই অবস্থা সৃষ্টি হয় তখনই যখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সুবিধা ও ক্ষমতার স্বার্থে অপরাধীদের রক্ষা করতে শুরু করে এবং ন্যায়ের পথে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকে। দলীয় প্রাপ্যতা ও ক্ষমতার লোভে তারা আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে আর এতে অপরাধীরা আরো সাহসী হয়। সাধারণ মানুষ তখন একদমই অসহায় হয়ে পড়ে। কারণ তার ধর্ম, রাজনৈতিক পরিচয় বা সামাজিক অবস্থান তাকে রক্ষা করতে পারে না; বরং তা তার জীবনের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যখন রাজনৈতিক শক্তিরা অপরাধীকে সুরক্ষা দেয়। তখন সমাজের নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং এ ধরনের অবক্ষয়ের ফলশ্রতিতে ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়। যা শেষ পর্যন্ত সবার জন্যই বিপদ ডেকে আনে। এজন্য আজকের সমাজে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বোধ, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে জোরদার পদক্ষেপ এবং একদিকে অপরাধীদের দমন করা এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অটল পদক্ষেপ নেওয়া। না হলে এই অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে পুরো সমাজই ধ্বংসের পথে পা বাড়াবে।
সোহাগ যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং যুবদলের কর্মী ছিলেন তা কোনো গোপন বিষয় নয়; অথচ আজ তার নির্মম মৃত্যু যে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তা মনে হয় যেন অস্বীকার করা হচ্ছে। বিএনপির মতো একটি প্রধান রাজনৈতিক দল যার একজন কর্মী এভাবে নৃশংসভাবে খুন হলেন। তার জন্য এখনো পর্যন্ত দলীয় কর্মীর স্বীকৃতি, কোনো প্রকাশ্য অবস্থান বা ঘোষণা না করাটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই নীরবতা শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নয় দলেরই অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতি ও নৈতিকতার জন্য বড় এক সংকেত বহন করে। এটি নির্দেশ করে যে, হয় তারা এই ঘটনায় বিব্রত বোধ করছে যা স্বাভাবিকই। কিংবা তারা হয়তো এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত বা অন্তত তার প্রতি অযত্নশীল। এই নীরবতা শুধু সোহাগের পরিবার ও সমর্থকদের হতাশ করছে না, বরং পুরো জাতির সামনে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে- কোন পথে যাচ্ছে আমাদের রাজনীতি? যেখানে প্রাণহানির ঘটনায় দলীয় সমর্থন না পাওয়া আর অবাস্তব নয়। এবং এটি একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকারণে দলের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্থ হয়।
এই ঘটনার বিচার শুধু আইনি না এটি রাজনৈতিক ও নৈতিক বিচারও। মহিন, অপু দাস ও সহযোগীদের দ্রুত গ্রেফতার, ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং যারা এদের প্রশ্রয় দিয়েছে তাদেরও রাজনৈতিকভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। না হলে এই সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। বিএনপি যদি আওয়ামীলীগের মতো অপরাধীদের আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে, কিংবা নীরব থাকে তবে জনগণ ধরে নেবে, এরা একই সাপের দুই ফণা।
সোহাগের পরিবারের কান্না আজ আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কান্না কি কেউ দেখছে? ব্যবসায়ী সোহাগের স্ত্রী লাকী আক্তার। তার ছেলে সোহান (চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র) আর মেয়ে সোহানা (ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী)। তাদের চোখের জল আজ আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে। একটি পরিবার, যার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে পাথর মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তারা এখন নির্জন ঘরের কোণে শোক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাঁদছে। লাকী আক্তার এখন শুধু একজন বিধবা নন। তিনি দুটো শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া একজন মা। যার চোখে এখন কোনো স্বপ্ন নেই শুধু প্রশ্ন আর কান্না। এই পিতৃহীন শিশুদের জীবনে আমরা কী দিতে পারি? তাদের শিক্ষা, জীবিকা, সামাজিক মর্যাদা সবকিছু আজ হুমকির মুখে। সমাজ কি প্রস্তুত তাদের পাশে দাঁড়াতে? রাষ্ট্র কি তাদের জন্য কোনো সহানুভূতি দেখাবে? আর রাজনৈতিক দল যাদের সঙ্গে সোহাগ যুক্ত ছিলেন তারা কি অন্তত এই পরিবারটিকে কোনো জবাব দেবে? না কি এই কান্নাও হারিয়ে যাবে আরও অনেক নিপীড়িত পরিবারের মতো? এই প্রশ্নগুলো আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে- উত্তরের অপেক্ষায়।
শেয়ার করুন