ছাত্রলীগের দুই নেতাকে নির্যাতনের ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা নিরূপণ করা হচ্ছে। ঘটনার সূত্রপাত থেকে শুরু করে থানায় মারধর করা পর্যন্ত যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তদন্ত কমিটি। ঢাকা মহানগর পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে দু’দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে তদন্ত সম্পন্ন করতে তারা আরও ৫ কর্মদিবস সময় পেয়েছে।
এ ঘটনায় চারটি পক্ষকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছেন পুলিশের এডিসি হারুন-অর-রশীদ, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক ও তার স্ত্রী পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন। এ ছাড়া হামলার শিকার ছাত্রলীগ নেতা ছাড়াও ঘটনাস্থলে উপস্থিত অন্যদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের দুই নেতাকে নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় আরও ৫ কার্যদিবস বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হওয়ায় কমিটি পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল।
তিনি আরও বলেন, গত শনিবার রাতে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনায় অভিযোগ ওঠার পর ডিএমপির পক্ষ থেকে ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের স্বার্থে এডিসি হারুন ছাড়া অন্য কারা ঘটনায় জড়িত ছিলেন, তাদের কার কী ভূমিকা ছিল এবং বারডেম হাসপাতালে (ঘটনার সূত্রপাত এখানে) কারা কারা ছিলেন– এসব তদন্ত করতে আরও সময় প্রয়োজন।
সেজন্য তদন্ত কমিটি আবেদন করায় ডিএমপি কমিশনার আরও পাঁচ কার্যদিবস সময় দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে ডিএমপি কমিশনার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এডিসি সানজিদাকে রংপুর বদলি করার খবরের সত্যতা নেই। এখন পর্যন্ত এমন কোনো আদেশ হয়নি। বদলির বিষয়ে কোনো আদেশের কপি পাই নাই।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের ঘটনার সূত্রপাত ব্যক্তিগত একটি বিষয় ঘিরে। এই ঘটনা ঘিরে যেভাবে একাধিক পুলিশ সদস্য ও রাষ্ট্রপতির এপিএস জড়িয়েছেন এটিকে তারা ভালো চোখে নেননি। সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ সন্তোষজক ছিল না। পুলিশ মনে করে, যে ক্যাডারের কর্মকর্তাই হোক, দায়দায়িত্ব নিরূপণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া অন্যদের কাছে একটি বার্তা দেওয়া যাবে। অনেকে এও বলছেন, হাসপাতালের মতো জায়গায় এমন পরিস্থিতি ঘটানো উচিত হয়নি।
এদিকে বারডেম হাসপাতালে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা তুলে ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন সেখানকার একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। সেই চিঠিতে বলা হয়, বারডেমের ইটিটি রুমের সামনে সেদিন মারামারি হচ্ছিল। নিরাপত্তা কর্মকর্তা ওয়ারেছ আলী দু’পক্ষকে অনুরোধ করে মারামারি থামান। পরে ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ এসে দু’পক্ষকেই থানায় নিয়ে যায়।
ঘটনার পরদিন রোববার ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ঘটনা সম্পর্কে অবগত করে চিঠি দেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলী। তিনি চিঠিতে লেখেন, শনিবার রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে আসা একদল দর্শনার্থী ইটিটি (এক ধরনের শারীরিক পরীক্ষা) কক্ষের সামনে মারামারি করেন। হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শন করে এসে তিনি এই মারামারি দেখতে পান। দু’পক্ষকে অনুরোধ করে তিনি মারামারি থামাতে সমর্থ হন। মারামারিতে লিপ্ত ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে চাইলে প্রথমে তারা জানাতে রাজি ছিলেন না। পরে অনুরোধ করলে তারা পরিচয় দেন। এতে জানা যায়, একজন রাষ্ট্রপতির এপিএস ও অন্যজন পুলিশ কর্মকর্তা হারুন। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তিনি ৯৯৯-এ ফোন করেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে রমনা ও শাহবাগ থানার পুলিশ এসে তাদের নিয়ে যায়।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপির তদন্ত কমিটির সদস্যরা আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন নাঈমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে যান। এ সময় আহত ছাত্রলীগ নেতা নাঈম বলেন, এডিসি হারুনকে সাময়িক বহিষ্কার করে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এর ওপর আমি কোনো আস্থা রাখছি না। এতে আমি সন্তুষ্ট নই। তদন্ত কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা বিবেচনা করে আমি এগোব। যদি তদন্ত কমিটি তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি স্থায়ী বহিষ্কার করে এবং আমার ওপর যে ফৌজদারি অপরাধ করেছে সেটার জন্য যদি তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে আমি সন্তুষ্ট। না হলে আমি আইনি লড়াইয়ে যাব।
এ সময় তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। পরে নাঈমের কাছ থেকে সেদিন বারডেম হাসপাতাল ও শাহবাগ কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত শোনেন তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) আবু ইউসুফ। এ সময় তাঁর সঙ্গে কমিটির সদস্য এডিসি শাহেন শাহ ও এডিসি (ডিবি-মতিঝিল) রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে নাঈমের পরিবারকে সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে নাঈম বলেন, ‘মামুন ভাইয়ের ফোনের কারণে সেখানে গিয়েছি। এর আগে কোনো কিছুই জানতাম না আমি। সানজিদা আফরিনকে সেদিনই সেখানে প্রথম দেখেছি।’
নাঈমের সঙ্গে তদন্ত কমিটির সাক্ষাতের বিষয়টি তার পরিবার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছে।
শেয়ার করুন