ফারুক আহমদ
স্টাফ রিপোর্টার
রক্ত দানের কথা বলে ডেকে এনে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া দুই তরুণী অবশেষে মুখ খুলেছেন। সোমবার ২৬ সেপ্টেম্বর বেলা ২টায় সিলেট প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। এ সময় লিখিত বক্তব্যে দুই তরুণী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মামলার মাত্র দুই আসামি- তানিয়া ও রাহি গ্রেফতার হয়েছে। তবে, মূল হোতা জুবেলসহ অন্য আসামিরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
তবে এই ধর্ষণ কান্ডে অভিযুক্ত কথিত যুবলীগ নেতা রানা আহমদ শিপলু ও মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাবিন রাজা চৌধুরী ছিলেন না বলে জানিয়েছেন দুই তরুণী ।
এ সময় তারা আরো অভিযোগ করেন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচারপ্রার্থী হওয়ায় অনেকটা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। নানা রকম চাপের মুখে এখন অনেকটা আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে তাদের।
আসামিরা মামলা আপোষ করার জন্য আমাদের দু’জনকে বিভিন্ন মাধ্যমে অবিরত চাপ দিচ্ছে। তারা আরও বলেন, এত বড় ঘটনার পরও আসামিরা থেমে নেই। আমাদের মোবাইল ফোন তাদের কাছে থাকায় ফোনে থাকা ব্যক্তিগত কিছু ভিডিও এবং ছবি এডিট করে বিভিন্ন আপত্তিকর কথা জুড়ে দিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হলে আমাদের মৃত্যু ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। কারণ- সাধারণ মানুষ কোনটা এডিট আর কোনটা সত্যি ভিডিও সেটি বুঝতে পারবে না। দুই তরুণী তাদের মোবাইল ফোন দ্রুত উদ্ধারের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ জানান।
তারা বলেন, সব আসামি গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তারা আমাদের সর্বস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। বেঁচে থাকার অধিকারও যাতে কেড়ে নিতে না পারে সে ব্যবস্থা করুন। পাশবিক নির্যাতনের শিকার দুই তরুণী নিজেদের মামলায় এজহারনামীয় দুই আসামির সংশ্লিষ্টতা নেই বলে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, আমরা মামলায় সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার আলী আকবরের ছেলে যুবলীগ নেতা রানা আহমদ শিপলু ওরফে শিবলু ও সুনামগঞ্জ সদর থানার হরিনাপাট গ্রামের ফরহাদ রাজা চৌধুরীর ছেলে মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাগঠনিক সম্পাদক নাবিন রাজা চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেছিলাম। পরবর্তীতে পুলিশ যখন আমাদেরকে নাবিন-শিপলুসহ অভিযুক্তদের ছবি দেখায় তখন নাবিন-শিপলু সেদিন আমাদের নির্যাতন করেনি বলে আমরা নিশ্চিত হই।
তবে কী কারণে তাদেরকে আসামি করা হয়েছিল জানতে চাইলে তারা জানান, অভিযুক্ত আসামিদের মুখে তাদের দুজনের নাম শুনেছি। তাই মামলায় তাদের নাম দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে ছবি দেখার পর নিশ্চিত হই ঐদিন নাবিন-শিপলু আমাদের উপর কোন প্রকার নির্যাতন করে নি।
তারা আরও বলেন, আমরা চাই আমাদের উপর যারা সত্যিই নির্যাতন চালিয়েছে তাদেরই বিচার হোক। নিরপরাধ কোনো লোক যাতে এ ঘটনায় ফেঁসে না যায় সে বিষয়ে আপনাদের মাধ্যমে আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
প্রসঙ্গত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তারা বলেন, ২৩ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিযুক্ত ধর্ষণ কান্ডে জড়িত প্রধান আসামী তানিয়া ফোন করে বলে তার ভাইয়ের জন্য এবি (+) পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ মিল থাকায় আমরা দুজন তৎক্ষণিক রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালের সামনে যাই। সেখানে গিয়ে তানিয়াকে দেখতে পেয়ে রক্ত দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় রক্ত দেওয়ার আগে তার এক কাজিনের সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন শেষ করে তারা আমাদের নিয়ে হাসপাতালে যাবে। এ কথা বলে তানিয়া দুই কিশোরীকে নিয়ে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী গ্রিন হিল আবাসিক হোটেলের ৪র্থ তলায় নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তানিয়ার এক সহযোগী- সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে মোহাইমিন রহমান রাহি আমাদের দুজনকে ৩০৩ নম্বর ও ৩০১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়।
এ সময় সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার গোবিগন্দগঞ্জ গ্রামের মৃত তহুর আলীর ছেলে জুবেল ও সুজন নামের একজনসহ আরও ৬-৭ জন যুবক তাদেরকে আলাদা দুটি আটকে রেখে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। এরপর তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকাসহ জরুরি জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ওদের কাউকে না চিনলেও তারা পরষ্পর একে অপরকে নাম ধরে ডাকায় এবং পরবর্তীতে পুলিশ আসামীদের ছবি দেখানোর পর তাদের নাম-পরিচয় জানতে পারেন।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, রাহি ও জুবেলের উদ্দেশ্য ছিল সিলেটের বিভিন্ন লোকজনকে ফাদে ফেলে আমাদেরকে ব্যবহার করে টাকা আদায় করা। সেদিন তারা হোটেলে আমাদেরকে এমন প্রস্তাবও দিয়েছিল।
তারা আরও বলেছে- তাদের কথামতো না চললে আমাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে। আমাদের নিয়ে জোরপূর্বক করা ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তারা আরও জানান, একটি বিভীষিকাময় রাত শেষে পরদিন দুপুরে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি এ মর্মে আমাদের (রিয়া ও চম্পা) কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক কথা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে। এরপর দুপুর একটার দিকে তারা আমাদের হোটেল থেকে বের করে দেয় এবং আমাদের মোবাইল ফোনসহ সঙ্গে থাকা সব জিনিসপত্র রেখে দেয়। এ সময় জুবেল ও তানিয়া বলে- তাদের কথামতো চললে তিনদিন পর মোবাইলসহ সবকিছু ফিরিয়ে দেবে। দুই তরুণী বলেন, আমরা সেদিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় এবং শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় দ্রুত ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করি। পরবর্তীতে আমরা (রিয়া ও চম্পা) জালালাবাদ থানায় গিয়ে পৃথক মামলা দায়ের করি।
শেয়ার করুন