লঙ্কার পর কোন কাণ্ড?- ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

আপনি কি জানেন আমাদের কাঁচামরিচের মোট চাহিদার কত অংশ দেশে উৎপন্ন হয়? যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, প্রায় শতভাগ! কী বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য দেখুন। তারা বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে কাঁচামরিচের চাহিদা থাকে ১৫ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপন্ন হয়েছিল ১৪ দশমিক ৯২ লাখ টন!

অবশ্য গত বছর এ পরিমাণ কিছুটা কমে হয়েছিল ১৪ দশমিক ৫৩ লাখ টন। তবুও সেটা চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ। তাহলে মাত্র ৩ শতাংশের ঘাটতিকে পুঁজি করে এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটাল কারা, কেনইবা ঘটল এতসব বিপত্তি?

বলতে পারেন, এ বছর তীব্র দাবদাহ ও আগাম বৃষ্টির কারণে মরিচের ফুল ঝরে গেছে, গাছ মারা গেছে, ফলন কম হয়েছে। কথা সত্য। কিন্তু তার পরিমাণ কেমন, খুব কি বেশি? সংশ্লিষ্ট কৃষক, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতা সবাই মিডিয়ায় বলেছেন, মরিচের চাষ (বা সম্ভাব্য) উৎপাদন এবার ‘কিছুটা’ কম।

তাছাড়া জুলাই-আগস্ট হলো কাঁচামরিচের মৌসুম। তাই ঈদের সপ্তাহখানেক পূর্বেই আগাম উৎপাদন হওয়া মরিচগুলো বাজারে আসতে শুরু করেছিল। তার পরও কেন এমন অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হলো?

এর জবাব পেতে শুধু এ ‘মরিচকাণ্ডকে’ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না। কারণ কিছুদিন আগেই ঘটেছিল পেঁয়াজকাণ্ড। তার আগে ডিমকাণ্ড পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছিল। এভাবে পেছনে যেতে থাকলে মুরগি, চিনি, লবণ, সয়াবিন তেল, চাল, আলু প্রভৃতি কাণ্ড ঘটেছিল।

তাই মরিচের উৎপাদন, বণ্টন, পাইকারি-খুচরা মূল্য ইত্যাদি কারণই সব নয়। বরং যারা এসব কাণ্ড ঘটায় তাদের কাছে এটা নিতান্তই এক ‘আইটেম’ মাত্র। আর সে কারণেই মনে শঙ্কা জাগে, লঙ্কার পর আবার কোন কাণ্ড জাতির জন্য অপেক্ষা করছে?

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কীভাবে বাড়ে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। বেশ ক’বছর আগের কথা। সুবিদবাজারে এক মুদি দোকানে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল কিনছিলাম। দরকষাকষির পর তিনি আমাকে ৫৬০ টাকায় দিতে রাজি হলেন। দোকানদার সেটা আমাকে দেয়ার পাশাপাশি ছোট্ট টেলিভিশনে খবর দেখছিলেন।

সেখানে ভোজ্যতেল-সংক্রান্ত এক লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছিল। রিপোর্টার ঢাকার এক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইল, আজ তিনি কত দামে বিক্রি করছেন? বিক্রেতা জানাল ৬৫০ টাকা। ব্যস, আমার সামনেই পরের কাস্টমারের কাছে দোকানদার দাম চাইলেন ৬৫০ টাকা! ক্রেতা আপত্তি জানালে তিনি জোর গলায় বললেন, ‘আজ মোকামে তেলের দাম বেশি!’

অর্থাৎ যেকোনো অজুহাতে বেশি দাম চাইলেই সেটা পাওয়া যায়। কোনো জবাবদিহিতার ব্যাপার নেই। বিশ্ববাজারে দাম কমলে বা সরকার বিশেষ সুবিধা দিলে তখন তিন মাসেও সেটার দাম কমে না। তখন যুক্তি দেখান, সেগুলো বেশি দামে কেনা। কিন্তু দাম বাড়াতে ১ মিনিটও সময় লাগে না। সেটা যে আগের রেটে কেনা তা সহসাই ভুলে যান।

খুব একটা প্রতিবাদও হয় না। কারণ ক্রেতারা সংখ্যায় লাখ লাখ হলেও তাদের কোনো সমিতি নেই, চাপ প্রয়োগের সিস্টেম নেই। অথচ কোথাও দোকানদার পাঁচজন হলেও তারা ঐক্যবদ্ধ। কেউ জোরালো আপত্তি জানালে বা প্রতিবাদ করলে মুহূর্তে তাকে হেনস্তা করা হয়। ফলে এমন অরাজক পরিস্থিতিতে তারা যা চাইবে তা-ই হবে। বহুদিন থেকে সেটাই হয়ে আসছে।

সাধারণত কাঁচামালের ওজন অনেক বেশি হয়। প্রতিদিন হাজার বা লাখ কেজির কারবার। ফলে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এতে জড়িত বড় ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজিতে ‘পয়সা’য় লাভ করেন। অর্থাৎ একজন পাইকার বা আড়তদার মরিচের কেজিতে হয়তো ৫০ পয়সা বেশি নেন। এতেই তার প্রত্যাশিত মুনাফা হয়। কারণ দিনে ২০ হাজার কেজি মাল লেনদেন হলে তার নিট ১০ হাজার টাকা লাভ হয়।

এবার ভাবুন, সেই জায়গায় প্রতি কেজিতে যদি ৫০০ টাকা গ্যাপ হয় তবে একদিনে কত টাকা অতিরিক্ত পকেটে ঢোকে? অর্থাৎ গত রাতে যে মরিচ ১০০ টাকা ছিল সকালেই তা ৬০০ টাকা হয়ে গেছে! তাহলে তার আয়ত্তে ২০ হাজার কেজি মাল থাকলে কত টাকা অনায়াসে তার ঘরে আসবে? মাত্র ১০ লাখ টাকা!

ভাবতে পারছেন বিষয়টা? একজনের যদি এ অবস্থা হয় তবে এক সপ্তাহ এমন অস্থিরতা বজায় রাখতে পারলে সারা দেশে মোট কত টাকা ক্রেতাদের পকেট থেকে উজাড় হয়?

বলতে পারেন, কৃষকও তো বেশি দাম পেয়েছে। তা পেয়েছে, তবে কতটা বেশি পেয়েছে? বড় লেনদেন হওয়া জায়গাগুলোয় কৃষক কেজিতে পেয়েছেন ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। অথচ তা বিক্রি হয়েছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত! তাহলে মাঝের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কাদের পকেটে গেছে?

কৃষিপণ্যের মার্কেটিং-সংক্রান্ত এক আলোচনায় বলেছিলাম, মানুষের পেট মোটা হওয়া যেমন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়; ঠিক তেমনিভাবে পণ্যের মধ্যস্থ কারবারীরা বেশি লাভ করা সেই পণ্যের জন্য কল্যাণকর নয়। বাজারের আকস্মিক উচ্চমূল্য থেকে উৎপাদনকারী (কৃষক) তেমন কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। অথচ ক্রেতাদের পকেট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, ক’দিন পর পরই কীভাবে তারা এমন কারসাজি করার সাহস পায়? উত্তর খুব সহজ। এর আগে যারা এমন অপকর্ম করেছে তাদের কিছু হয়নি, ভবিষ্যতে হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আজ পর্যন্ত তাদের কারো ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়নি, জেল-জরিমানা বা বড় কোনো শাস্তি হয়নি।

তাছাড়া বিস্ময়করভাবে, মিডিয়ার হেডলাইন থেকে প্রসঙ্গটা সরে গেলেই আমরা সেটা দ্রুত ভুলে যাই। ওই সংকটের গভীরে যাওয়া, প্রকৃত চিত্র অনুসন্ধান, দোষীদের শাস্তি প্রদান কিংবা ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর নীতিমালা করা… এর কোনোটাই হয় না। ফলে তারা মাঝে মধ্যে একেকটা হুজুগ তুলে শত বা হাজার কোটি টাকা মার্কেট থেকে তুলে নেবে সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

অনেকে হয়তো বলবেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তো অভিযান পরিচালনা করেছে। অনেককে জরিমানা করেছে। কথা সত্য, তারা ভালো কাজের চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির লোকবলে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা গোটা জেলা বা একাধিক জেলার দায়িত্বে থাকেন। তারা যখন বাজার মনিটরিংয়ে যান, সাময়িক সচেতনতা বাড়ে। কিন্তু সেখান থেকে অভিযান পরিচালনাকারী দল চলে যাওয়ামাত্রই সব আগের মতো হয়ে যায়।

তাছাড়া তারা সাধারণত যান ছোট বা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা কম পরিমাণে পণ্য কিনে সেদিনই বিক্রি করে। হুজুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো দাম কিছুটা বেশি রাখেন। সেটা ধরা পড়লে জরিমানা হয়। সেটার পরিমাণ জানেন তো, ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা! কিন্তু সত্যিকারের যারা কলকাঠি নাড়েন সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের গুদাম পর্যন্ত পৌঁছা মাঠপর্যায়ের কর্তাদের সাধ্যে কুলায় না। অন্তত গণমাধ্যমে তেমন কোনো খবর আসে না।

যেসব পণ্য নিয়ে মাঝে মধ্যেই হাহাকার ওঠে সেসব সেক্টরে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী থাকেন প্রবল ক্ষমতাধর। তারা সুযোগ বুঝে একেকটা গুজব ছড়িয়ে দেন। পণ্যের বড় অংশের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ান। বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। তখন মিডিয়া সোচ্চার হয়, টক শো জমে ওঠে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ নেয়।

কাঁচামরিচের ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে। আমরা জানি, ১০ মাস ধরে কাঁচামরিচ আমদানি বন্ধ ছিল। এ কারসাজি উপলক্ষে আমদানির পথটা আবার উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু দেশে এখন কাঁচামরিচ উৎপাদনের মৌসুম। আগামী মাসেও এর ব্যাপক সরবরাহ থাকবে। এ অবস্থায় হাজার হাজার টন এলসির মরিচ দেশে ঢুকলে সাধারণ কৃষক কি তার পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে? উত্তর অজানা নয়।

কেউ কেউ বিরূপ আবহাওয়াকে দায়ী করেছেন। কিন্তু সেটা তো একদিনে হয় না। দেশে মরিচের চাষ বা উৎপাদন এ বছর যে কিছুটা কম হচ্ছে তা কৃষি দপ্তর আগেই জানত। তাই কয়েক মাস আগেই কাঁচামরিচ আমদানির উদ্যোগ নেয়া যেত। দেশে মৌসুম শুরুর আগেই সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য বজায় থাকত।

কিন্তু সেটা না করে একদিকে সরবরাহ ঘাটতির অজুহাতে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হলো। অন্যদিকে ভরা মৌসুমে আমদানি পণ্য এসে পৌঁছায় মরিচচাষীরা হবেন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে অনেকে নিঃস্ব হয়ে বা রাগে-দুঃখে আগামী বছর হয়তো মরিচ চাষ করবে না। তখন আরো আমদানির পথ সুগম হবে। সঙ্গে নিজেরাই চাহিদা মেটাতে সক্ষম এমন একটা পণ্যের ক্ষেত্রেও বাড়বে আমদানিনির্ভরতা।

ক’দিন পর পরই একেকটা পণ্যে এমন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। এটা যে প্রকৃত সংকট নয় তার প্রমাণ হলো—টাকা দিয়েও মরিচ পাওয়া যায়নি, দেশের কোথাও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। অর্থাৎ উচ্চ দাম দিলেই পণ্য মিলছে।

তার মানে কারো না কারো কাছে সেটা মজুদ ছিল। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায় না। এমনকি তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ এমন পরিস্থিতি রোধে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম শক্তিশালী করা দরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি।

আর মিডিয়ার ঝড় থেমে গেলেই সেটা ভুলে গেলে অচিরেই অন্য কোনো আইটেমে তেমনটা ঘটবে। তাই সাম্প্রতিক লঙ্কাকাণ্ডের গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দরকার। তাহলে ভবিষ্যতে অন্যেরা তেমনটা করার সাহস পাবে না। মনে রাখতে হবে, গুটিকয়েক অসৎ লোককে সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষকে কষ্ট দেয়া দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না, আনতে পারে না।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১১ জুলাই ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *