আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের শক্তি পরীক্ষা আজ

রাজনীতি

রংপুরের কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে বিএনপির গণসমাবেশ আজ বিকালে। একই দিন প্রায় একই সময়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংলগ্ন মাঠে। দুই দলের এই কর্মসূচি ঘিরে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক জনসমাগম ঘটানো নিয়ে। এ নিয়ে এক ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি দেশের বড় এই দল দুটি। উভয় দলই চায় ব্যাপক শোডাউনের মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থন প্রমাণ করতে। বিএনপির টার্গেট রংপুরের সমাবেশে ৫ লাখ লোকের উপস্থিতি।

আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, ঢাকার সম্মেলনে বিপুলসংখ্যক লোকসমাগমের মধ্যদিয়ে বিএনপির রংপুরের সমবেশের উপস্থিতি ছাপিয়ে যেতে। এমন ইঙ্গিত দিয়ে ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছেন, জনসমাগম কাকে বলে তা বিএনপিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে

আর গতকাল বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার মতো রংপুরের সমাবেশকেও বন্ধ করার জন্য সরকার পেটুয়া ইউনিয়নকে দিয়ে ধর্মঘট ডাকাচ্ছে।’ রংপুরে ব্যাপক সমাগম হবে বলে আশাবাদ জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জনগণ হেঁটে বিভিন্নভাবে সমাবেশে এসে উপস্থিত হচ্ছে। বৃহত্তর রংপুরের জনগণ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে জানান দেবে এই সরকারকে আমরা চাই না।’

রংপুরের গণসমাবেশ উপলক্ষে মঞ্চ তৈরির কাজ তদারকি করছেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবীব দুলু। তিনি বলেন, ‘পরিবহন ধর্মঘট দেওয়া হবে তা আমরা আগে থেকেই জানতাম। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রয়োজনে এই বিভাগের আট জেলার মানুষ হেঁটেই সমাবেশে যোগ দেবে।’

গতকাল রাতে সমাবেশস্থলে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা মুঠোফোনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ। সমাবেশের মাঠে কোন বৈদ্যুতিক সংযোগ দিতে দেওয়া হয়নি। ধর্মঘট উপেক্ষা করে বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশ মাঠে জমায়েত হচ্ছেন। অন্ধকার মাঠেই রাত কাটবেন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।’

সমাবেশকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রংপুর মহানগর পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ঢাকা টাইমসকে গতকাল বিকালে বলেন, পুলিশকে সর্বোচ্চ ধৈর্যধারণ করতে বলা হয়েছে। তবে জনগণের জানমাল রক্ষার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সমাবেশকালে দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ। পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক এই সমাবেশকে ঘিরে যে কোনো নাশকতা, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।’ অন্যদিকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগ্রহণ করেছে পুলিশ।

এদিকে বিএনপির সমাবেশের আগের দিন গতকাল সকাল থেকে রংপুরের সকল রুটে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এ বাধা ডিঙিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা যে যেভাবে পারছেন, রংপুরের উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই যাত্রা শুরু করেছেন। যদিও ধর্মঘটের মতো পরিস্থিতি আগাম অনুমান করতে পেরে সাত দিন আগেই বিএনপির হাইকমান্ড থেকে মাঠপর্যায়ে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে ব্যাপক উপস্থিতি ঘটাতে। ধর্মঘটের মতো পরিস্থিতি পার হয়ে সমাবেশে পৌঁছাতে বিকল্প কৌশল নিতেও ওই বার্তায় নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে দলটির শীর্ষ পর্যায় ও মাঠ পর্যায়ের একাধিক নেতা ঢাকা টাইমসকে নিশ্চিত করেছেন।

আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড থেকেও ব্যাপক শোডাউন ঘটাতে তৃণমূলে বার্তা পাঠানো হয়েছে কয়েকদিন আগেই। জানা গেছে, বিএনপির রংপুরের সমাবেশের জবাব ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকেই দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির যে কয়টি সমাবেশ হয়েছে, তার দ্বিগুন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের ওই বার্তায় বলা হয়। বার্তা পাওয়া একাধিক নেতা ঢাকাটাইমসকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে আগে যেখানে বাণিজ্য মেলা হতো, সেই মাঠে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কাল শনিবার। আগে এ সম্মেলন ঢাকা শহরে হতো না। বিএনপির ধারাবাহিক সমাবেশের পাল্টা জবাব দিতেই কালকের এ সম্মেলন ঢাকায় হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। সেখানে ব্যাপক জনসমাগম দলটি করতে চায় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে তার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জনসমাগম কাকে বলে কাল (শনিবার) থেকে বিএনপিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। বিএনপির তিনটি সমাবেশ দেখেই সরকারের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে- মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এখানে সরকারের কাঁপাকাঁপির কী আছে? কোনো কোনো সমাবেশে ১০ লাখের টার্গেট করেও ১ লাখ হয়নি, আবার কোথাও ৫ লাখ টার্গেট করে ১ লাখের অর্ধেকও হয়নি। এটাই তো বিএনপির সমাবেশের চেহারা।’ ওবায়দুল কাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীতে ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলনে কত হাজার লোক হয়েছে, তা দেখুন; যা পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে।’

অন্যদিকে পরিবহন ধর্মঘট উপেক্ষা করে আজ রংপুরে গণসমাবেশ করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী বিএনপি। পথে পথে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা রংপুরে পৌঁছেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, খাবার সংকটের আশঙ্কায় চিড়া-মুড়ি-কম্বল নিয়ে আসছেন সমাবেশে আগতরা।

দলটির একাধিক নেতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনা গণসমাবেশে ক্ষমতাসীনরা ব্যাপক বাধা দিয়েছে। গণপরিবহন-লঞ্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পথে পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, হামলা-মামলা গ্রেপ্তার চালানো হয়েছে। তারপরও সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সমাবেশগুলোতে জনতার ঢল নেমেছে। রংপুরেও ঐতিহাসিক গণসমাবেশ হবে। বিএনপি নেতারা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় তারা রংপুরের সমাবেশেও পরিবহন ধর্মঘটের আশঙ্কা করেছিলেন। সেটিই হয়েছে। সে অনুযায়ী আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে এই গণসমাবেশে মানুষ আসবে। সমাবেশে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষের জমায়েতের প্রত্যাশা দলটির।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ৯ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশের পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে দলটি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় সমাবেশ হয়েছে। যথারীতি রংপুরের গণসমাবেশেও প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। সমাবেশ সফল করতে বিভাগের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে লিফলেট বিতরণসহ চালানো হচ্ছে প্রচারণা। সাঁটানো হয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন, করা হয়েছে মাইকিং। রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক সভার মাধ্যমে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। আয়োজকদের ধারণা, রংপুরের বিভাগীয় গণসমাবেশে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমাগম ঘটবে।

খুলনা-ময়মনসিংহের মতো বাস বন্ধ থাকতে পারে, এমন আশঙ্কায় আগেই করণীয় ঠিক করে দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। পরিবহন ধর্মঘটের আশঙ্কায় বিভিন্ন জেলা থেকে দু-তিন দিন আগেই রংপুর পৌঁছেছেন অনেক নেতাকর্মী-সমর্থক। রেলস্টেশনে রাত কাটিয়ে তাদের অনেকে কম্বল বিছিয়ে সমাবেশস্থলে থাকছেন। বিএনপি নেতাদের প্রত্যাশা, বাকিরা আজ সকালের মধ্যেই সমাবেশসস্থলে পৌঁছাবেন।

দলটির বিভাগীয় কয়েকজন নেতা জানান, ট্রেন, নছিমন, করিমন, সাইকেল ও মোটরসাইকেলে সমাবেশে আসছেন কর্মীরা। নিকট দূরত্বের অনেকে হেঁটেও আসছেন। বিভাগের ৮ জেলাতেই ট্রেন সুবিধা থাকায়, ট্রেনেই বেশি আসবেন সমাবেশে আগতরা।

এদিকে রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশের দুদিন আগেই পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে জেলা মোটর মালিক সমিতি। অবৈধ যান চলাচল বন্ধের দাবিতে গতকাল ভোর ৬টা থেকে আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে এ ধর্মঘট। রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশের সমন্বয়কারী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিভাগীয় গণসমাবেশ নিয়ে আমরা প্রস্তুত। সরকার ধর্মঘটসহ যে কোনোভাবে বাধা দিয়েও গণসমাবেশে গণজোয়ার ঠেকাতে পারবে না।’

সমাবেশ নিয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ক্রাইম) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমরা বিএনপির এই সমাবেশ নিয়ে কোনো বাধা দিচ্ছি না। আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক এই সমাবেশকে ঘিরে অন্য কোনো পরিকল্পনা থাকলে আমরা কঠোর হস্তে তা দমন করব।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *