আগুনেও সাহস হারাননি

জাতীয়

প্রশিক্ষণ বিমানে আগুন ধরলেও দুই বৈমানিক (পাইলট) হারাননি সাহস। দক্ষতার সঙ্গে বিমানটি ঘনবসতিপূর্ণ চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা থেকে জনবিরল স্থানে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে কর্ণফুলী নদীতে এসে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেন দুই পাইলট। তবে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের (৩২) জীবন বাঁচেনি। অন্য পাইলটও গুরুতর আহত হয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর জুলধা ১১ নম্বর মাতব্বর ঘাটসংলগ্ন এলাকায় বিমানটি ছিটকে পড়ে। এর আগে আগুন লাগার পরপরই বিমান থেকে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেওয়া দুই পাইলটকে উদ্ধার করেন কর্ণফুলী নদীতে চলাচলরত নৌকার মাঝিরা। আহত উইং কমান্ডার সুহান বিমানবাহিনীর ঘাঁটি জহুরুল হকের মেডিকেল স্কোয়াড্রনে চিকিৎসাধীন। দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে বিমানবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আইএসপিআরের সহকারী তথ্য কর্মকর্তা আয়শা ছিদ্দিকা জানান, সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি ইয়াক-১৩০ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর কর্ণফুলীর মোহনার কাছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে।

স্থানীয়দের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শুরুতে বিমানের পেছনের অংশে আগুন লাগে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিমানটিতে। এরপর সেটি টুকরা হয়ে পানিতে ছিটকে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শী কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা এলাকার বাসিন্দা মো. পারভেজ জানান, মাতব্বর ঘাট দিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম নগরে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি বিমান উড়ে আসতে দেখেন। হঠাৎ দেখেন, বিমানের পেছনে আগুন ধরেছে। মুহূর্তের মধ্যে বিমানটি নদীতে আছড়ে পড়ে। বিমান থেকে দু’জন পাইলট প্যারাসুট নিয়ে নদীতে পড়ে যান। এ সময় নৌকার মাঝি ও যাত্রীরা মিলে তাদের উদ্ধার করে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তের ঘাটে নিয়ে যান। পরে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলটদের উদ্ধার করে বানৌজা পতেঙ্গা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়।

এদিকে এ ঘটনায় নিহত আসিম জাওয়াদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান।

বিধ্বস্ত বিমানের একাংশ উদ্ধার 

কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত বিমানের একটি অংশ উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে জুলধা মাতব্বর ঘাটসংলগ্ন এইচএম স্টিল কারখানার পাশে কর্ণফুলী নদী থেকে অংশটি উদ্ধার করা হয়। তবে এখনও উদ্ধারকাজ শেষ করা হয়নি। এর আগে তারা সোনার নামে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে নদীর তলদেশে তল্লাশি চালিয়ে বিধ্বস্ত বিমানটির একাংশ শনাক্ত করা হয়। এরপর রাতে নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ বলবান অংশটি উদ্ধার করে।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘নৌবাহিনী এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজ শেষ করেনি। তারা আমাদের প্রতিবেদন দিলে উদ্ধারের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারব। তবে বিধ্বস্ত বিমানের একটি অংশ উদ্ধার হয়েছে বলে শুনেছি।’

পেশাগত জীবনে সাফল্যে উজ্জ্বল আসিম জাওয়াদ

মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের জন্ম ১৯৯২ সালের ২০ মার্চ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার গোপালপুর গ্রামে। তিনি ২০০৭ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে বিএসসি (অ্যারো) পাস করেন।

জাওয়াদ ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি ক্যাডেটের সর্বোচ্চ সম্মান সোর্ড অব অনার প্রাপ্তিসহ জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। চাকরিকালে তিনি বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি পেশাদারি দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মফিজ ট্রফি’, ‘বিমানবাহিনী প্রধান ট্রফি’ ও বিমানবাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র পেয়েছেন। এ ছাড়া ভারতীয় বিমানবাহিনীতে কোর্সে অংশ নিয়ে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘চিফ অব এয়ার স্টাফ ট্রফি ফর বেস্ট ইন ফ্লাইং’ অর্জন করেন।

‘কখন আসবে জাওয়াদের ফোন’

মানিকগঞ্জ শহরের পৌর ভূমি অফিসের সামনের গোল্ডেন টাওয়ারের সাততলায় থাকেন আসিম জাওয়াদের মা-বাবা। ছেলের মৃত্যুর খবরে পাগলপ্রায় হয়ে বিলাপ করছেন জাওয়াদের মা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নীলুফা আক্তার খানম। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলে প্রতিদিন সকালে ফোন করে। আজ এখনও করেনি। কখন আসবে জাওয়াদের ফোন!’

নীলুফা আক্তার খানম ও ডা. আমান উল্লাহর একমাত্র সন্তান ছিলেন জাওয়াদ। বাবা আমান উল্লাহ নবীনগর এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জাওয়াদ আট বছর আগে নারায়ণগঞ্জের রিফাত অন্তরাকে বিয়ে করেন। তাদের ছয় বছরের একটি মেয়ে ও এক বছরের ছেলে আছে। তারা চট্টগ্রামেই থাকেন।

নিহতের মামা সুরুয খান জানান, তাঁর ভাগনের স্বপ্ন ছিল পাইলট হবে। এ কারণে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়নি। তিনি জানান, শুক্রবার মানিকগঞ্জ শহরের সেওতা কবরস্থানে জাওয়াদের লাশ দাফন করা হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *