আমি তোমার বিরহে রহিব – আল-আমিন

সম্পাদকীয়

আমি তোমার বিরহে রহিব
আল-আমিন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের মহাকবি। তিনি ছিলেন বাঙালির অগ্রণী কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্ট্রা, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।
তিনি বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। তিনি কবিগুরু ও বিশ্বকবি হিসেবে ভূষিত। তিনি বাংলা সাহিত্যকে সারাবিশ্বে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভায় সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রষ্ট্রা গায়ক, সমালোচক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে অনন্য। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে বদলে দিয়েছেন বাঙালির মানসজগত এবং বাংলাকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবন- চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য হয়ে আছেন। আমাদের জীবনের সঙ্গে, চেতনায়, মননে, আন্দোলনে, ভাষার মাধুর্যে, দেশপ্রেমে সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথে আছেন।

এই বিশ্বকবিকে নিয়ে গুটিকয়েক গ্রন্থ পড়ে তাঁর সম্পর্কে লেখা যায় না। তাকে নিয়ে লিখতে হলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান থাকা দরকার। যা আমার এই জ্ঞানের পরিমান সিকি আনাও নেই। তারপরও সাহস করে লিখতে বসেছি। শত বছর আগে এই প্রেমের মহাকবি সিলেটে এসেছিলেন। পদাচারণ দিয়েছিলেন সিলেট এমসি কলেজে। তিনিই আমার প্রিয় কবি সেই সুবাদে এই লেখাটি লিখছি।

আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিকতা, সৌন্দর্য, চেতনা, সাহিত্যভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষা, কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। সমাজকল্যাণে তিনি গ্রামোন্নয়ণ ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। তিনি শহর থেকে গ্রামকে গুরুত্ব দিয়েছেনন। তিনি বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তিনি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। তিনি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি গানকে মানুষের মাঝে আবেগ ভালবাসায় বিলিয়েছেন। কবির প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে তাঁর প্রকাশিত মানসী এবং তারপর প্রকাশিত সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা ও ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে কবির প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোমান্টিক ভাবনা। তাঁর কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য কবির রচিত নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি কাব্যগ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি পূরবী ও মহুয়া কাব্যগ্রন্থে প্রেমকে উপজীব্য করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় কাব্য গ্রন্থ পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী নামে চারটি গদ্যকাব্যও বাংলা সাহিত্যকে বেশ সাড়া জুগিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, কবীরের দোঁহাবলি, লালনের বাউল গান ও রামপ্রসাদ সেনের শক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি একটি সহজ ও কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব হয়। সারা দুনিয়ায় এই কবিগুরুর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি বাংলা ভাষার সব মানুয়ের মুখে মুখে। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থটি একটি গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ হিসেবে সমাধিত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে বেশ জায়গা দখল করেছে। হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজপত্র মাসিক পত্রিকায় তার ছোটগল্পগুলো নিয়মিত প্রকাশ হতো। এই গল্পগুলোও ছিল উচ্চমানের সাহিত্য সম্পন্ন। কবির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল কঙ্কাল, নিশীথে, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, স্ত্রীর পত্র, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, দেনাপাওনা, মুসলমানীর গল্প ইত্যাদি। কবি তাঁর শেষ জীবনে লিপিকা, সে ও তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থ নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।

তিনি তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন। কবির একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত মনিহারা, পোস্টমাস্টার ও সমাপ্তি অবলম্বনে তিন কন্যা। নষ্টনীড় অবলম্বনে চারুলতা। তপন সিংহ পরিচালিত অতিথি, কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ। পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি ব্যাপক সমাধিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছেন, বৌ-ঠাকুরাণীর হাট, রাজর্ষি, চোখের বালি, নৌকাডুবি, প্রজাপতির নির্বন্ধ, গোরা, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, দুই বোন, মালঞ্চ ও চার অধ্যায়। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং এদুটি উপন্যাস কবির প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা। এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলোও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজপত্র,
বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালিও ছিল অসাধারণ সৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলো সমাজ সংকলনে সংকলিত হয়েছে। কবির বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলো সংকলিত হয়েছে কালান্তর সংকলনে। তাঁর ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণ গুলোও সংকলিত হয়েছে
ধর্ম ও শান্তিনিকেতন অভিভাষণ মালায়। তিনি ইতিহাস সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলো ভারতবর্ষ, ইতিহাস ইত্যাদি গ্রন্থে তুলে এনেছেন। সাহিত্য, সাহিত্যের পথে ও সাহিত্যের স্বরূপ গ্রন্থগুলোতেও সাহিত্যতত্ত্ব রয়েছে। সভ্যতার সংকট তার সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে যা দিয়ে এখানকার সময়ের সাইন্সফিকশন সাহিত্য রচনাকারীদের জন্য খুব তথ্যবহুল গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা ও আত্মপরিচয় তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী, ভানুসিংহের পত্রাবলী ও পথে ও পথের প্রান্তে বই তিনটি রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য পত্রসংকলন। বিশ্বকবির পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, আনুষ্ঠানিক ও বিচিত্র পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত করা হয়েছে। এরমধ্যে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন বিশেষভাবে গ্রহনযোগ্য।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ে বিরাজমান। তিনি নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনা, মেধা ও শ্রমে নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন যা তাঁকে বহুমাত্রিক গুনের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নিজের বিরাট সৃষ্টিশীল ক্ষমতা তাঁকে এক যুগোত্তীর্ণ মহাপুরুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা যে ক’জন বড় মাপের কবি এর মধ্যে একজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের রবি কিরণের উন্মেষ ঘটিয়েছেন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্য ও সুন্দরের মতো বহমান এবং সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে এবং বাংলা সাহিত্যজগতে পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন ঐশ্বর্য নিয়ে। বাঙালির সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুলাংশ জুড়েই আছেন আমাদের এই রবী ঠাকুর। বাঙালি তাই তাঁর প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে আশ্রয় নেয় তাঁর সৃষ্টির কাছে। রবীন্দ্রনাথ নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন দৃষ্টির সীমানায়। যে দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বয়ে। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে জীবনের প্রভাত থেকে অন্তিম পর্যন্ত।

আমাদের প্রাণের, চেতনার, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে শিল্পের সৃষ্টির টানে। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী ও সুর আমাদের হৃদয়ে জাগিয়ে দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, জীবনের কবি, প্রকৃতির কবি, গানের কবি, মানুষের ভালোবাসার কবি হয়ে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে অপার্থিব আনন্দলোকে আনন্দের বিস্তৃৃতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাঙালি হয়েও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাঁর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা ছড়া, কবিতা কিংবা বড়দের জন্য লেখা কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাসে আমরা বাঙালির সহজ সরল জীবনকে তুলে ধরতে দেখি। তাঁর নানা কাব্যগীতিতে আমরা প্রেম সৌন্দর্য, রোমান্টিক ভাবনা, আধ্যাত্মিক কল্পনার চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ গল্প উপন্যাস এখনো আমাদের মনকে আনন্দিত করে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও মঞ্চে রাজা ও রানী, বিসর্জন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, চিরকুমার সভা, বাল্মিকী প্রতিভা, তাসের দেশ, ডাকঘর, রাজা, মুক্তধারা, অচলায়তন, শেষের কবিতা কবির অসাধারণ সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ আছেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে তাঁর সৃষ্টির উৎসারণে কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, মঞ্চনাটক, টিভি নাটক, নৃত্যনাট্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত এবং বাংলার সমগ্র সংস্কৃতিতে। তিনি তাঁর মানবীয় উচ্চ ভাবনা-চেতনা আর মানুষের চিরায়ত অনুভূতি ভাষার সৌকর্য সাধন আর নিপুণ শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে কাব্য-সঙ্গীত-প্রবন্ধ-গল্পে আর চিত্রকলায় রূপায়িত করে মানুষের চেতনাকে শানিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ব্যাপকতা বিশ্বজুড়ে শিখরস্পর্শী প্রতিভায় উদ্ভাসিত যা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তায় ছড়িয়েছে রবির আলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনকে শিল্পবোধ থেকেই অনুভব করেছেন। আর সেজন্য তাঁর শিল্প-সৃষ্টি প্রায়শই জীবনসংলগ্ন। তিনি কাব্য, গল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটককে জীবনের প্রতিভায় সঞ্চিত করেছেন। যা রূপালঙ্কার, প্রতীক ও বিমূর্ততার দ্যোতনায় হয়েছে উজ্জ্বল। সব মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। দেড়শ বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে চিরজাগ্ররত হয়ে আছেন। সমগ্র বাঙালির মানস জগতে রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন আবেগ, প্রেরণায় জাগ্রত এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আলোর দিশারি হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন যুগ থেকে যুগান্তরে। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবন দর্শন আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে সত্য ও সুন্দরের।

রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কবিমানস ও সাহিত্যকর্মের স্বরূপ অনুধাবন সম্ভব। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যাদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা,  দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান,  ছোটগল্প,  উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য,  নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপ ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তর অধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘অভিলাষ’ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১২৮১ সনে। কারও কারও মতে প্রথম কবিতা ‘ভারতভূমি’ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় মুদ্রিত কবিতা ‘প্রকৃতির খেদ’ ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হয়।
সে সময় রবীন্দ্রনাথ অধ্যয়নের মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। একই সঙ্গে চলে সাহিত্য চর্চাও। জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব পত্রিকায় তাঁর বনফুল এবং  ভারতী পত্রিকায় কবি-কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এরপর তিনি একে একে রচনা করেন ছবি ও গান, প্রকৃতির প্রতিশোধ, কড়ি ও কোমল, মায়ার খেলা ও মানসী কাব্য। পাশাপাশি লেখেন গদ্যপ্রবন্ধ, সমালোচনা, উপন্যাস প্রভৃতি। এ সময়ই রচিত হয় তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস বউঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষি। এরপর কবি কল্পনার জগৎ থেকে নেমে আসেন বাস্তব পৃথিবীর প্রত্যক্ষ জীবনে। ফলে রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো। এছাড়া উত্তর ও পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি অপরূপ রূপে প্রতিভাত হয় তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রে, যেগুলো ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী নামে সংকলিত হয়েছে। জীবনের এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি তদারকি উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান যেমন শাহজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম ও শিলাইদহে ঘুরে বেড়ান। এই সূত্রেই শিলাইদহে গড়ে ওঠে একটি কবিতীর্থ। পদ্মাবক্ষে নৌকায় চড়ে বেড়ানোর সময় পদ্মানদী, বালুচর, কাশবন, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দরিদ্র জীবন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা কবিকে গভীরভাবে আলোড়িত করে।

রবীন্দ্রপ্রতিভার পূর্ণ দীপ্তির বিচ্ছুরণ ঘটায় সাধনা পত্রিকায়। এ পত্রিকায় তিনি ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর শিক্ষাবিষয়ক মতামত এবং রাজনৈতিক আলোচনা-সম্বলিত লেখা ওই পত্রিকাতে ছাপা হতো। শিক্ষা ও রাজনৈতিক বিষয়ে কবির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ। ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব দেন। রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই গঠনমূলক কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজের জাতি, সমাজ ও দেশকে উত্তমরূপে জানা, বৃহত্তর মানবিক নীতিবোধ দিয়ে নিজেদের সংশোধন করে চলা এবং বিদেশি শাসকের ভিক্ষার দানে নির্ভরশীল না থেকে আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠা এসব ছিল তাঁর প্রবন্ধমালার মূল বক্তব্য। এ সময়ের প্রবন্ধে একদিকে ফুটে ওঠে বাঙালি সমাজের নানা দিক নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা আবার অন্যদিকে ভারতের ঐতিহ্য, তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতি এবং ঐক্যসাধনার ধারার স্বরূপ। সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা, ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনী কবির  শিলাইদহ পর্বের রচনা। এ পর্বের কবিতায় জীবনের বাস্তব চিত্র এবং সৌন্দর্যবোধ, বর্তমান কাল ও প্রাচীন ভারত, সমকালীন সমাজ ও ইতিহাসের মহৎ আত্মত্যাগের কাহিনী একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।

কবির স্বদেশ পর্বের বেশকিছু  উল্লেখযোগ্য গান রচিত হয়। তাঁর দুটি গান বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বাংলাদেশের এবং ‘জন গণ মন’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এ সময় রবীন্দ্রনাথ দেশ ও সমাজকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার বিস্তৃত কর্মসূচি তুলে ধরেন তাঁর বিখ্যাত ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে শান্তিনিকেতন পর্বের ছাপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে রচিত নৈবেদ্য কাব্য এবং নানা প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতের ধ্যান ও তপস্যার রূপ ফুটে ওঠে। চোখের বালি, নৌকাডুবি, এবং গোরা উপন্যাসে একদিকে জীবনের বাস্তবতা, মনস্তত্ত্ব এবং অন্যদিকে স্বদেশের নানা সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন তিনি।

একদিকে জাতীয় প্রকৃতি ও তার ইতিহাসের ধারা কবির কাছে হয়ে ওঠে গভীর অর্থবহ, আর অন্যদিকে অধ্যাত্মভাবনায় তাঁর চিত্ত ধাবিত হয়। এই অনুভূতিরই প্রকাশ খেয়া ও গীতাঞ্জলি কাব্য এবং রাজা ও ডাকঘর নাটক। এ পর্বে দুঃখ ও মৃত্যুর তত্ত্বকে কবি জীবনের তত্ত্বে অর্থান্বিত করে তুলেন। গীতাঞ্জলি কাব্যের কিছু কবিতা কবির শিলাইদহে থাকাকালে রচিত, তবে অধিকাংশই শান্তিনিকেতনে লেখা। গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য গুলো ঋতুভিত্তিক উৎসবের জন্য তিনি রচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র সৃষ্টির অন্যতম ধারা তাঁর অসাধারণ গান। এই সঙ্গীতপ্রতিভা পারিবারিক সূত্রেই অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয় তাঁর মধ্যে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গানের বাণী ও সুরে নব নব নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন সঙ্গীতের এক স্বতন্ত্র জগৎ, যা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি এবং কালক্রমে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠে কালজয়ী।

ক্রমাগত অধ্যয়ন, যোগাযোগ ও বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চলমান বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ফলে তাঁর কবিমানসের পরিবর্তন এবং কাব্যসাহিত্যে তার প্রভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে। গীতাঞ্জলির চেতনার ধারা গীতিমাল্য ও গীতালি কাব্যেও বজায় ছিল।
এর মূলে ছিল রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতালব্ধ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।

বলাকা কাব্যের পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা কখনও সুখ-দুঃখ-বিরহ-মিলনপূর্ণ মানব সংসারে বিচরণ করেছে। আবার কখনও নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যলোকে যাত্রা করেছে। এই জীবন ও অরূপের সমন্বয় সাধনজনিত অস্থিরতা থেকে কবি মুক্তি পায় বলাকা কাব্যে এসে। বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারার দুঃখবোধ ও মানসিক দ্বন্দ্ব তাঁর সন্ধ্যাসংগীত কাব্যের মূল সুর। প্রভাতসংগীতে অনন্ত প্রেমে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানবকে আহবান জানান। কড়ি ও কোমল কাব্যে রূপে-বর্ণে-ছন্দে সমৃদ্ধ প্রকৃতি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষায় বিজড়িত মানুষ তাঁকে আকৃষ্ট করেছে, তবে এ মানুষ বৃহত্তর দেশে কালে পরিব্যাপ্ত বিশ্বমানব। সোনার তরী যুগে সৌন্দর্যের নিরুদ্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষার প্রবণতা কবিকে অসম্পূর্ণ মানবের সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। মানসী, সোনার তরী এবং চিত্রায় সীমা ও অসীমের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে কবিমানসের যাত্রা চলেছে। তিনি জীবের মধ্যেই জীবনেশ্বরকে দেখেছেন। খেয়া থেকে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত কবি সাধনায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। বলাকায় প্রচন্ড জীবনাবেগ নিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। রবীন্দ্র-কবিমানসের এই আকস্মিক পালাবদলের কারণ সমগ্র বিশ্বের মানবিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। এ সময় আধুনিক বিশ্ব জীবনবাদের সঙ্গে কবির গভীর সংযোগ সাধিত হয়। বস্তুত জীবন জিজ্ঞাসা ও প্রকাশরীতির বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাচ্য চিন্তা এবং পাশ্চাত্য ধারণার সমন্বয় সাধনই কবির বৈশিষ্ট্য এবং বলাকা নবজীবনবাদের কাব্য। এতে বিষয়বস্তু ও ভাবগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবি কলাকৌশলেও অভিনবত্ব এনেছেন। বস্তুজগতে পরমাণুর নিরন্তর গতি, অবিরাম প্রবাহ আর ছন্দের স্পন্দন যেন তাঁর চেতনার জগতেও সৃষ্টি করেছে এক প্রবল ছন্দোময়তা। তাই মুক্ত ছন্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি ভাষা ও ছন্দের নিরীক্ষা করেছেন বিভিন্ন কবিতায়।

১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির  জন্য রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসম্মান নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এশিয়ায় তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে বাংলা ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহন করেছেন। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স  দ্বারকানাথ ঠাকুর।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে কলকাতার জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাড়িতে জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়।

লেখক:
কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *