মেধা পাচার বাড়ছে

সম্পাদকীয়

ন্দোলন। তখন থেকে শ্রীলংকায় আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি থেকে দক্ষ ও শিক্ষিত শ্রেণীর লোক ব্যাপক হারে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। কমবেশী একই দৃশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধার অভাবের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে বিদেশে যাওয়ার পর আর দেশে ফিরে আসতে চাইছেন না। এভাবে দেশ দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মক্ষম মানুষ হারাচ্ছে। দেশে নিজেদের ভবিষ্যত আশা প্রত্যাশার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা না দেখে অনেকেই এভাবে দেশ ছাড়ছেন। তরুণ যুবাদের মাঝে এই প্রবণতা ইদানিং তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন অবৈধ পথে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ গমনের পাশাপাশি বৈধপথে ভ্রমণ ও উচ্চ শিক্ষার নামে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এদের অধিকাংশই বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসছেন না। এভাবে দেশে দক্ষ, শিক্ষিত ও কর্মক্ষম মেধাবী মানুষের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

বলা বাহুল্য, একজন মেধাবী শুধু নিজের ব্যক্তিগত জীবনেই নয় বরং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মেধার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অভূতপূর্ব অবদান রাখতে সক্ষম। এরূপ মেধাবী ব্যক্তিরা যখন তাদের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান তখন তাকে মেধা পাচার বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তৃতীয় বিশে^র অনুন্নত দেশ থেকে পশ্চিমাদের উন্নত দেশগুলোতে এই মেধা পাচারের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার সম্ভাবনাময় মেধা পাচার হয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। এরা সেই মেধাবী এজন্য তারা দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছে। যে দেশের মাটিতে তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই দেশ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সেবা থেকে। ইউনোস্কো’র ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টার্শিয়ারী লেভেলের স্টুডেন্টস’ বিষয়ক রিপোর্ট ২০১৯-২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৭৭৬৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশে^র বিভিন্ন দেশের বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় আমেরিকাতে বিদেশেী শিক্ষার্থী ভর্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিগত শিক্ষাবর্ষের ১৪তম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে ১৩ তম হয়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, শুধু কি উচ্চ বেতন অথবা উন্নত জীবন যাপনের আশায় মানুষ বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমায়? আসলে তা নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশে মেধার যাথাযথ মূল্যায়নের অভাব। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটি দেখা যায়। বাংলাদেশে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা ইত্যাদির কদর ও মূল্য দেয়া হয় অনেক বেশী। এদেশে মেধাবীরা পদে পদে বিব্রত ও অপদস্থ হয়। দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক জুনিয়র ও অযোগ্যদের উর্ধতন পদ প্রদান করা হয়। বিশেষ দলের পরিচিতি বা সনদ না থাকলে চাকুরী পায় না শিক্ষিত বেকারেরা। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, যা ঘটার তা-ই ঘটছে। ব্যাপক হারে পাচার হচ্ছে মেধা। বিদেশ হচ্ছে উপকৃত, দেশ হচ্ছে বঞ্চিত।

ইউনেস্কে এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কের পরামর্শ অনুযায়ী, মেধা পাচার ঠেকাতে একটি দেশের জিডিপি’র কমপক্ষে ৪-৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতি বছর এই কাথে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। গত কয়েক দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলো পাচার হয়ে যাওয়া মেধা ফিরিয়ে আনতে এবং মেধা পাচার ঠেকাতে নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ বিষয়ে নির্বিকার।

তারা জনশক্তি রফতানী ও মেধা পাচারের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজতে নারাজ। মেধাশূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা বিশে^র বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষিত ও প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পেতে হয়রান হতে হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান প্রয়োজন। এই প্রায় উপেক্ষিত সমস্যার দিকে ক্ষমতার শীর্ষ মহলকে দৃষ্টি দিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ। এদেশের সচেতন মহল এটাই প্রত্যাশা করেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *