মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি ইসরাইল এবং ইরান। কয়েক দশক ধরে চলমান দুই দেশের সাপে-নেউলে সম্পর্ক সম্প্রতি ব্যাপক রূপ নিয়েছে। অথচ ইসরাইলের সঙ্গে একসময় ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল! তবে দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পর ক্রমবর্ধমান ভাবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। যা শনিবার সরাসরি সংঘাতে রূপ নিল। এতদিন ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলি হামলার জবাবে হুমকি-ধমকি কিংবা প্রক্সি লড়াই চালালেও এই প্রথম সরাসরি ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামলা চালাল ইরান!
ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়েছে ইসরাইল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র অনারব দেশ ইরান সেসব সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। শেষ গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেটে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইল। এতে বিপ্লবী গার্ডের দুই কমান্ডারসহ ৭ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হন।
সে হামলার জবাবে রোববার (১৪ এপ্রিল) ইসরাইলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে কয়েক ডজন ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান।
ইরান-ইসরাইলের সম্পর্কের ইতিহাস
ইরান ও ইসরাইলের সম্পর্ককে চারটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত সময়কাল; ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পাহলভি রাজবংশের যুগে বন্ধুত্বপূর্ণ সময়কাল; ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইরানি বিপ্লবের পর অবনতিশীল সময়কাল এবং ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে প্রকাশ্য শত্রুতা।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ফিলিস্তিনকে ভাগ করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যে ১৩টি দেশ ভোট দিয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল ইরান।
কিন্তু পরবর্তীকালে ইরান ইসরাইলকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এমনকি তুরস্কের পর ইরান ছিল ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। ১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমাপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ইরানের শাহ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ইরান। একই সঙ্গে ইরানের ইসলামপন্থী সরকার একটি রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইলের বৈধতা অস্বীকার করে।
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে শীতল সম্পর্ক থেকে খোলামেলা শত্রুতা শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পরাজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যের আপেক্ষিক ক্ষমতা ইরান এবং ইসরাইলে চলে যায়। এসময় ইসরাইলে আইজাক রাবিনের কট্টরপন্থি সরকার ইরানের প্রতি আরও আক্রমনাত্মক হয়ে উঠলে সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যায়। মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক বিবৃতি দিতে থাকেন।
দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পেছনে কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তির উন্নয়ন, লেবাননে হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ এবং হামাসের মতো ইসলামপন্থী দলগুলিকে ইরানের সমর্থন। সেইসাথে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলায় ইরানের জড়িত থাকার অভিযোগ। যেমন ১৯৯২ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে ইসরাইলি দূতাবাসে হামলা এবং ১১৯৪ সালের এএমআইএ বোমা হামলা এবং ইরানের পিপলস মুজাহেদিন এবং জুন্দাল্লাহর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীকে ইসরাইলের সমর্থন এবং একাধিক হত্যাকাণ্ড, বোমা হামলাসহ ইরানে ইসরাইলের কথিত গোপন অভিযান।
১৯৮৫ সাল থেকেই ইরান এবং ইসরাইল একটি প্রক্সি দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে; যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।