গতকাল শুক্রবার ১৫ জুলাই নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় ১৮ বছর বয়সী এক কলেজ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে এ ঘটনার সূত্রপাত।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের ফাঁদে পড়ে নড়াইলের হাজার বছরের ঐতিহ্য-সম্প্রীতির বন্ধনকে ম্লান না করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ওজা।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসুবক টাইমলাইনে এ বিষয়ে আজ শনিবার ১৬ জুলাই বিশদভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছেন মাশরাফি। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতেও বলেছেন তিনি। মাশরাফি জানান, এই দেশ আমাদের, এই মাটি আমাদের। এই মাটি যেন কারও জন্য অনিরাপদ না হয়। পাঠকদের জন্য মাশরাফির লেখা স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
গতকাল আমাদের এলাকায় এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে এবং প্রতিটি মুহূর্তে পোড়াচ্ছে। সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়; এমন কাজ করা থেকে দয়া করে বিরত থাকুন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের ফাঁদে পড়ে নড়াইলের হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনকে এক নিমিষে ম্লান করে দেবেন না। ছেলেবেলা থেকে যে নড়াইলকে দেখে এসেছি, যে নড়াইলকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই নড়াইলের সঙ্গে এই নড়াইলকে আমি মেলাতে পারছি না।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। আজীবন শান্তি ও সম্প্রীতির দূত ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। অজ্ঞতা থেকে হোক কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে, কেউ যদি মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কেউ যদি সত্যিই এমনটি করে থাকে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিচার হবে।
দয়া করে আপনারা শান্তি বজায় রাখুন। উত্তেজিত না হয়ে একটু ভাবুন। ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটিয়ে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আমার নড়াইলকে এমন কলঙ্কিত করবেন না।
ঘটনা শোনামাত্র আমি স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে। তাৎক্ষণিক নড়াইলের পুলিশ সুপার, ডিআইজি মহোদয়, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি আমার স্থানীয় নেতাকর্মীদেরও ঘটনাস্থলে দ্রুত পাঠিয়েছি, তারা যেন অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায়। খুলনা থেকে র্যাব পাঠানো হয়েছে। এত কিছুর পরও ভীষণ দুঃখজনক কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে স্থানীয় বেশ ক’জন নেতাকর্মী আঘাত পেয়েছেন। তবে অসহায় মানুষের আর্তনাদের কাছে সেটা কিছুই নয়। একজন সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হলে সেই ক্ষতি অপূরণীয়। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের জন্য আমার মন কাঁদছে।
ঘটনার সময় শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছি, ঘটনার পর আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদেরকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা থেকে শুরু করে মানসিকভাবেও পাশে থাকব বলে কথা দিয়েছি। তাতে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ হবে না। তবে আপনাদেরকে বলছি, আমরা আপনাদের পাশে সর্বতোভাবে আছি। আপনারা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করুন। এই দেশ, এই মাটি, এই আলো-বাতাস, আপনার-আমার সবার।
মসজিদের সম্মানিত ইমামদের আমি অনুরোধ করব, এই দুঃসময়ে আপনারা নিজ নিজ এলাকার মুসল্লিদের শান্তির ধর্ম ইসলামের বাণী বেশি বেশি শোনান। শান্তিপ্রিয় মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের কাহিনী শোনান। নবীজির জীবনের আদর্শ, তাঁর মূল্যবান বাণী শোনান।
সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্মানিত পুরোহিতদেরও অনুরোধ করব, আপনারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাণী তরুণ প্রজন্মসহ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন।
এই দেশ আমাদের, এই মাটি আমাদের। এই মাটি যেন কারো জন্য অনিরাপদ না হয়, ৭১-এর মতো বুক পেতে সবাইকে আগলে রাখতে হবে আমাদের; এক মুহূর্তও সেই আদর্শ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আর যেন কোনও ঘটনা না ঘটে, এজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নজরদারির অনুরোধ করেছি।
শান্তিপূর্ণ এই এলাকায় কেন এমনটা ঘটল, এটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখব আমরা। সব ধর্মের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমি এর মধ্যেই কথা বলেছি। আরও যা যা করণীয়, করার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। আমি সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।”
এর আগে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ ওই শিক্ষার্থীর বাবাকে বাড়ি থেকে পুলিশ হেফাজতে নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়েছে বলে জানান এলাকাবাসী ও পুলিশ। আজ সকাল ৮টা পর্যন্ত ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি।
এ বিষয়ে লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজগর আলী বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে আমরা এখনও পাইনি। তাই তার পোস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। এটি কোনও সংগঠিত হামলা নয়। দিঘলিয়া একটি বড় বাজার হওয়ায় এটি একটি বিচ্ছিন্ন হামলা। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। মন্দিরে কিছু ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয়েছে।