মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী মো. জাকির হোসেন। এই জেলা অফিসে আছেন ১৫ বছর হয়। দীর্ঘদিন একস্থানে চাকরি করার ফলে জাকির হোসেন গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির এক মহাসিন্ডিকেট। কখন কোন শিক্ষকের ঘাড়ে ঘুষে’র চাপ আসে সেই আতঙ্কে থাকেন জেলার শিক্ষকরা।
২০০৮ সালে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে যোগদানের পরই যেন আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পান জাকির। অল্প দিনেই বনে যান অঢেল সম্পদের মালিক। জেলায় জায়গা কিনে বাড়ি বানিয়েছেন। কিনেছেন দামি গাড়ি। বিয়েও করেছেন দুটি। দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাংকে এবং নিজের নামে পূবালী ব্যাংকে রয়েছে এফডিআর।
অভিযোগ উঠেছে, নতুন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে পদায়ন, চাহিদাসম্পন্ন বিদ্যালয়ে বদলি (অনলাইন বদলি চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত), শিক্ষকদের অবসর ও মৃত্যুজনিত কাজসহ বিভিন্ন কাজে জেলায় কর্মরত শিক্ষকদের জিম্মি করে ঘুস নেন জাকির। এর মাধ্যমেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অধীন কর্মচারীরা একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। এমন বিধিমালা থাকলেও জাকিরের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।
জানা যায়, ২০০৮ সালে মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে যোগদান করে ১৫ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত উচ্চমান সহকারী জাকির হোসেন। নানা অভিযোগে ২০১৪ সালে কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি করলেও তদবির করে ৬ মাসের মাথায় আবারও ফিরে আসেন মৌলভীবাজার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কোনো দিন অফিসের স্টাফ আসার আগে সকালে আবার কখনও সন্ধ্যায় নীরবে ঘুস বাণিজ্য করেন জাকির। অফিসকে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিণত করেছেন। উপজেলা অফিসগুলোতেও রয়েছে তার শক্ত সিন্ডিকেট। কিন্তু শিক্ষকরা হয়রানির ভয়ে প্রতিবাদ করেন না।
মৌলভীবাজারে যোগদানের পর থেকেই ঘুষ গ্রহণে বেপরোয়া হয়ে উঠেন জাকির। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন নিউ মডেলের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ ৩৪-২৮৯৪)। কাজের মেয়ে হোসনে আরার প্রেমে পড়ে ২০১০ সালে তাকে বিয়ে করেন।
মৌলভীবাজারের জগন্নাথপুর এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী হোসনে আরার নামে ৬ শতক জায়গা কিনে ৩ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাসা বানিয়েছেন। প্রতিবেদক তার বাসায় গিয়ে দেখতে পান হাতিলসহ দামি ব্র্যান্ডের ফার্নিচারে ড্রয়িং রুম সাজানো। সম্প্রতি কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ছেলের রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়ও রয়েছে তার অনেক সম্পদ। গ্রামের বাড়িতে থাকেন প্রথম স্ত্রী।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার এক শিক্ষিকা স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, আমার অনেক পরিচয় থাকার পরেও জাকির ভাইকে ৩ হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। এভাবে তিনি প্রতিটি কাজে শিক্ষকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করেন।
চলতি বছর নিয়োগপ্রাপ্ত কুলাউড়া উপজেলার একজন শিক্ষক বলেন, আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে পদায়ন করে দেবেন বলে জাকির ভাই আমার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় আমাকে ওই বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়নি।
সদর উপজেলার এক শিক্ষিকা বলেন, আমার এক আত্মীয়কে চাহিদাসম্পন্ন বিদ্যালয়ে পদায়ন করতে না পেরে জাকির ভাই ঘুষের টাকা ফেরত দিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সমিতির জেলা সভাপতি জহর তরফদার বলেন, অনেক শিক্ষকের মুখে আমিও তার (জাকির) বিরুদ্ধে ঘুসের অভিযোগ শুনেছি। এটা আমাকে পীড়া দেয়। কিন্তু শিক্ষকরা লিখিতভাবে আমাদের কাছে বলেননি। যার কারণে আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কিংবা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। তবে অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা নয়।
অভিযুক্ত জাকির হোসেন বলেন, প্রতিদিন নানা কাজে শিক্ষকরা আমার কাছে আসেন। তাদের কাজ করে দিলে অনেকে খুশি হয়ে কিছু টাকা দেন। কারও কাছ থেকে জোর করে কিংবা চুক্তি করে আমি টাকা নেইনি।
ব্যাংকের টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধান ডাকঘরে আমার স্ত্রীর নামে একটা সঞ্চয়পত্র ছিল। সেটা ভেঙে সোনালী ব্যাংকের কোর্ট শাখায় স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকার এফডিআর করেছি। পূবালী ব্যাংক ওয়াপদা শাখায় মাসিক ৫ হাজার টাকার একটা ডিপিএস রয়েছে।
মৌলভীবাজারে বাড়ি এবং গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক লোন এবং বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এগুলো করেছি। আমি অনেক টাকা ঋণে আছি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুর রহমান বলেন, জাকিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় কোনো শিক্ষক আমার কাছে কখনো বলেননি। তবে যেহেতু গণমাধ্যম অনুসন্ধান করে পেয়েছে আমি উনাকে মৌখিকভাবে সতর্ক করব। সূত্র: যুগান্তর
শেয়ার করুন