তুরস্কে রজব তাইয়েব এরদোগানের ২০ বছরের ক্ষমতার দৌড় আরো দীর্ঘায়িত হবে কি না, তা নির্ধারিত হবে আজ দ্বিতীয় দফা ভোটে।তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারুলু, যিনি বেশ কয়েকটি বিরোধী দলের জোটের সমর্থনপুষ্ট, এই ভোটকে তুরস্কের ভবিষ্যতের নির্ধারক বলে মন্তব্য করেছেন।এখনো পর্যন্ত এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোগানই ফেভারিট, মানে এগিয়ে আছেন বলে মনে হচ্ছে। তার সমর্থকদের ‘নতুন যুগ’এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বতর্মান প্রেসিডেন্ট।
তবে এ দফায়ও নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় মূল্যস্ফীতি ও জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি।রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৮টা (বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা) থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে, যা চলবে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা পর্যন্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা তুর্কি নাগরিকদের ভোট নেয়া এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।নির্বাচনের প্রথম ধাপে বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছিলেন, যা শতকরা হিসেবে মোট ভোটারের ৮৮.৮ শতাংশ।দুই প্রার্থীর নজরই এবার ৮০ লাখ ভোটারের দিকে, যারা আগেরবার ভোট দেননি কিন্তু এবার ভোট দিতে পারেন।
দ্বিতীয় ধাপের ভোটের আগে কিলিচদারুলু তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন।তার অভিযোগ, ভোটারদের কাছে তার পাঠানো টেক্সট মেসেজ ব্লক করা হয়েছে আর এরদোগানের পাঠানো টেক্সট মেসেজ স্বাভাবিকভাবেই পৌঁছেছে।
কোনো জায়গায় যেন ভোট জালিয়াতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বিরোধী জোট রীতিমতো স্বেচ্ছাসেবকদের বাহিনী মাঠে নামিয়েছে।আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে এরদোগান তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন।তবে কিছুটা সুবিধা পেলেও তা ভোটিংয়ের ফলাফল পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রেখেছে বলে তারা দাবি করছেন না।প্রচারণার শেষ দিনে বিরোধী জোটের নেতা কিলিচদারুলু বেশ অভিনব ধরনের প্রেসিডেন্সির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনতিনি বলেন, আমার প্রাসাদে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি আপনাদের মতো সাধারণভাবে থাকতে চাই…আর আপনাদের সমস্যা সমাধান করতে চাই।এই মন্তব্য আসলে এরদোগানের বর্তমান বাসভবনকে কটাক্ষ করেই করা হয়েছে।
২০১৪ সালে এরদোগান যখন প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট হন, তখন আঙ্কারার ঠিক বাইরে বিশাল এক প্রাসাদে তার বাসভবন স্থানান্তর করেন।তুরস্কের মানুষের মতামত এই মুহূর্তে দুই মেরুতে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের ওপর নির্ভরশীল।অন্যদিকে, বিরোধী নেতা কিলিচদারুলুর সমর্থকরা মূলত ধর্ম নিরপেক্ষ- তবে তাদের মধ্যে অনেক জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সমর্থকও রয়েছেন।দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগে টানা কয়েক দিন ধরে দুই ব্যক্তিই একে অপরকে খোঁচা দিয়ে মন্তব্য করেছেন।
কিলিচদারুলু প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তিনি ভীতু, তাই নিরপেক্ষ নির্বাচন থেকে দূরে পালাচ্ছেন।অন্যদিকে, এরদোগান তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।তবে এমন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান ইস্যু ছিল জিনিসপত্রের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি। তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার উঠেছে ৪৪ শতাংশে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এরদোগানের সুদের হার কমানোর নীতি পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের মুদ্রা লিরার দর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কমেছে এবং বিদেশী মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে।সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ২০০২ সালের পর থেকে প্রথমবার নেতিবাচক হয়েছে। এরদোগানের সময়কালে অর্থনীতির এই অবস্থা হওয়ার কারণে অনেকেই তার প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ।কিন্তু এই জনসংখ্যারই একটা বড় অংশ আবার এরদোগানের ওপরই আস্থা রাখছেন। অনেকেই মনে করেন বিরোধী জোটের সাথে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে, যেমনটা এরদোগান অভিযোগ করেছেন।
তবে তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল এইচডিডি পার্টি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী পিকেকে’র সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।এই বিরোধী জোটেরই প্রধান দলের সাথে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তবে, রোববারের নির্বাচনে যে দল বা জোটই জিতুক, তুরস্কের সংসদের দখল এরই মধ্যে এরদোগানের ইসলামপন্থী একে পার্টি এবং দক্ষিণপন্থী এমএইচপি পার্টির কাছে রয়েছে।
প্রথম ধাপের ভোটে এরদোগানের জোট ৪৯ দিশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যদিও বিরোধী জোটের সাথে তার ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম।কিলিচদারুলু প্রথম ধাপে ভোট পেয়েছিলেন ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ, অর্থাৎ এরদোগানের সাথে তার ব্যবধান ছিল খুবই কম।
কিলিচদারুলুর প্রতি সমর্থন রয়েছে ছয়-দলীয় বিরোধী জোটের। তুর্কি জনগণকে তিনি আশার বাণী শুনিয়েছেন এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।এরদোগান আবার নির্বাচিত হলে একটি নতুন ‘তুর্কি শতকের’ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তার সমর্থকরা বলছেন, তিনি আরো উন্নয়ন, আরো শক্তিশালী এক তুরস্ক উপহার দেবেন।
সূত্র : বিবিসি