রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা লাওহে মাহফুজে কোরআন নাজিল করেছেন। তা থেকে দীর্ঘ ২২ বছরে কোরআন আমরা পেয়েছি। জিবরাইলের (আ.) মাধ্যমে তা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। এ কোরআন সংরক্ষণ করেছেন নবীজি (সা.)।
সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামকে দিয়ে মুখস্থ করিয়েছেন। কাতেবে ওহিদের মাধ্যমে তা লিখিয়েছেন। রমজানের প্রতি রাতে জিবরাইলের (আ.) সঙ্গে কোরআন শোনানোর পুনরাবৃত্তি হতো। জিবরাইল (আ.) নবীজিকে শোনাতেন। নবীজি শোনাতেন জিবরাইলকে। এভাবে মাসজুড়ে কোরআনের চর্চা চলত নবী যুগে।
এ কোরআন চর্চার মাধ্যমে আমরা সাতটি উপকার পেয়ে থাকি। ১. কোরআন হলো সবকিছুর জ্ঞান। এতে জ্ঞানবিজ্ঞানের সবকিছু বর্ণনা করা হয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সব বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে এ কোরআনে। ২. কোরআনে রয়েছে হিদায়াত বা পথনির্দেশনা।
যে নির্দেশনা অনুসরণ করলে পার্থিব জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারবে, পারলৌকিক জীবনে মুক্তি লাভ করতে পারবে। অর্থাৎ কোরআনের পথেই কল্যাণ । ৩. কোরআন হলো রহমত। কোরআনের মাধ্যমে জাতিগত দ্বন্দ্ব বন্ধ হয়ে নিজেরা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছিল আরব জাতি।
৪. কোরআন হলো মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ। এ চারটি বিষয়কে একত্রে আল্লাহ তায়ালা সুরা আন নাহলের ৮৯ নম্বর আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি আপনার কাছে কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে রয়েছে সব ব্যাপারে সুস্পষ্ট বর্ণনা, পথনির্দেশনা, রহমত ও মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ।’ (আল-কোরআন, ১৬: ৮৯)
সুরা ইউনূসের ৫৭ নম্বর আয়াতে কোরআন নাজিলের আরো দুটি উদ্দেশ্য যুক্ত করা হয়েছে। যথা ১. কোরআন হলো উপদেশ। কোরআনে অনেক ইতিহাস আনা হয়েছে, গল্প আনা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও সরাসরি উপদেশ বাণী দিয়েছেন মহান রাব্বুল আলামীন।
২. কোরআনে রয়েছে অন্তরের চিকিৎসা। মানবিক গুণাবলি অর্জন করা যায় কোরআন পাঠের মাধ্যমে। বদঅভ্যাসগুলো দূর করে পৃথিবীকে উপহার দেওয়া যায় শান্তিময় পরিবেশ।
এ ছয়টি বিষয় ছাড়াও সাত নম্বর উপকারটি হলো কোরআন তার অনুসারীদের জন্য সুপারিশ করবে। যা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এ সুপারিশ পেতে হলে আমাদের চারভাবে কোরআন চর্চা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছেÑ
১. তিলাওয়াত বা রিডিং পড়া
কোরআন রিডিং পড়ায় মনের প্রশান্তি আসে। এতে হিদায়াত আছে। এতে সওয়াব আছে। প্রতিটি অক্ষর তেলাওয়াতে সওয়াব হয়। সওয়াব ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তাই আলহামদু বলার দ্বারা পাঁচটি অক্ষর উচ্চারণ করা হলো। তাতে ৫০ থেকে ৫০০ সওয়াব পাওয়া যাবে। সওয়াব হলো আখিরাতের মুদ্রার নাম। পৃথিবীতে যেমন যার যত ডলার বা টাকা আছে, সে তত উপকৃত হতে পারে, তত জিনিসের মালিক হতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে আখিরাতে যত বেশি সওয়াব হবে তত বেশি দামি হবে মানুষ।
২. কোরআনের অর্থ বোঝা
শব্দে শব্দে অর্থ বোঝা বা ভাবার্থ বোঝা। অর্থ বোঝার জন্য মূল আরবি জানা ভালো। যদি আরবি শেখা সম্ভব না হয়, তাহলে নির্ভরযোগ্য অনুবাদ পড়া যেতে পারে। বাংলা ভাষায় মৌলিক ও অনূদিত অনেক তাফসির পাওয়া যায়। তা পড়া যেতে পারে। আমার কাছে তাফসিরে মা’আরিফুল কোরআন ভালো লাগে। এটি ৮ খণ্ড। তবে মার্কেটে সংক্ষিপ্তাকারে এক ভলিয়মেও পাওয়া যায়।
রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি নিয়মিত কোরআনের তাফসির পড়া যায়। রমজানে যে তাফসির পড়া শুরু হলো, তা কন্টিনিউ চালিয়ে যাওয়া উচিত সারা বছর। তাহলে দুয়েক বছরে একবার পুরো কোরআনের অর্থ পড়া সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। পুরো কোরআন পড়া সম্ভব না হলে সুরা বাকারা, আলে ইমরান, নিসা, নূর, আহযাব, কাহাফ, ইয়াসিন, ওয়াকিয়া ও নামাজের সুরাগুলোর তাফসির পড়া সবারই উচিত।
৩. কোরআন নিয়ে গবেষণা করা
কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা থেকে নিগূঢ় তথ্য অনুধাবন করার জন্য। গবেষণা করার জন্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সামাজিক গবেষণা, অর্থনৈতিক গবেষণা, রাষ্ট্রচিন্তা ইত্যাদির জন্য কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে । ফিকহ গবেষণা করে কোরআনের আলোকে মাসয়ালা-মাসায়েলও জানতে হবে। আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
৪. আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করা
কোরআন পড়লে, অর্থ বুঝলে, গবেষণা করে রেজাল্ট বের করলেও কোনো কাজ হবে না, যদি তা বাস্তবায়ন না করা হয়। কোরআনের ছয় হাজার ২৩৬টি আয়াতের মধ্যে ৫০০ আয়াত রয়েছে সরাসরি আদেশ-নিষেধ নিয়ে। তাই এসব আদেশ নিষেধ মানতে হবে। পুরোপুরি মানতে হবে। একটি মানা হলো, আরেকটি মানা হলো নাÑ তাহলেও মুক্তি পাওয়া যাবে না। মুক্তি পেতে হলে, কোরআনের সুপারিশ পেতে হলে, পরিপূর্ণভাবে কোরআনের অনুসরণ করতে হবে।
আমরা অনেক সময় কোরআনকে অবহেলা করি। তা হয় মূলত আমাদের কোরআন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে। কোরআন প্রকৃত অর্থেই আলো। এ আলোর সন্ধান না পাওয়ার কারণে, এ বিষয়ে অমনোযোগী হওয়ার কারণে, অন্য জ্ঞানভাণ্ডারকে আমরা সর্বাধিক উপযোগী, সমকালীন ও প্রয়োজনীয় মনে করি। তখন কোরআনকে অতিরিক্ত বিষয় বা অপশনাল মনে করি। এটা আমাদের ভুল। যদি কোরআন শিখে অন্যান্য জ্ঞানার্জন করি, তাহলে সবকিছুই আমাদের জন্য উপকারী হবে। কোরআন বর্জন করে যতই জ্ঞানার্জন করা হোক তা হবে অন্ধকারতুল্য। কোরআনসহ জাগতিক জ্ঞান হলো সোনায় সোহাগা।
এ রমজানের রোজা ও কোরআন দুটিই আমাদের জন্য সুপারিশকারী হবে। এ রমজানে রোজা রাখার পাশাপাশি আমরা উপর্যুক্ত চারভাবেই কোরআন চর্চা করব। যেন আমরা কবরে, আখিরাতে কোরআনের সুপারিশ লাভ করতে পারি এবং আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে চিরস্থায়ী জান্নাত পেতে পারি।
লেখক : অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন