চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এ খবরে সিলেটের গ্যাস গ্রাহকদের মাঝে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। যদিও এই শঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, সিলেটের গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
তবে নগরীর শিবগঞ্জ, সোনারপাড়া, মিরাবাজার, উপশহরসহ কয়েকটি এলাকার একাধিক গ্রাহক শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাসের চাপ কম রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তারা জানান, শুধু আজ নয়, প্রতি শুক্রবারে এসব এলাকায় কয়েক ঘন্টা গ্যাস থাকেনা। এছাড়া সন্ধ্যার পর গ্যাস থাকলেও চাপ কম থাকায় কোন কিছু রান্না করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।
নগরীর সোনারপাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার বেলা ১১টার পর থেকে আমাদের এখানে কয়েকঘন্টা গ্যাস ছিলনা। শুক্রবার এলেই এমন সমস্যা হয়। এছাড়া সন্ধ্যার পর লাইনে গ্যাস থাকলেও চাপ কম থাকায় আমাদের গৃহিনীদের বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে।
একই রকম অভিযোগ নগরের যতরপুরের এক বাসিন্দাসহ আরো কয়েকজনের।
এ ব্যাপারে জালালাবাদ গ্যাস টি অ্যান্ড ডি সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিটিডিএসএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ আতিকুর রহমান (চলতি দায়িত্ব) দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকলেও সিলেটে এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সিলেটে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
এদিকে, এদিকে মাসের লোড শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে সিলেটের বেশ কয়েকটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সিএনজি ফিলিং স্টেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কয়েকটি পাম্পে দিনের বেলায় কিছু সময় বন্ধ রাখতে দেখা গেছে। এতে খোলা থাকা অন্যান্য পাম্পগুলোতে যানবাহনের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। অনেক চালককে ২ থেকে ৩ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়ীতে গ্যাস লোড করতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, মহেষখালীর মাতারবাড়িতে এলএনজি টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বন্দর নগরীসহ পুরো চট্টগ্রামের আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতের কোথায়ও গ্যাস নেই। শুক্রবার ছুটির দিনে জ্বলেনি রান্নার চুলা। ঘরে ঘরে হাহাকার চলছে। বন্ধ রয়েছে গ্যাস নির্ভর শিল্প কারখানা। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সিএনজি ফিলিং স্টেশন সব বন্ধ রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের মহেশখালিতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। মেরামত শেষে দীর্ঘ আড়াই মাস পর একটি এলএনজি টার্মিনাল মাতারবাড়িতে এনে সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে সেটি বিকল হয়ে পড়ায় গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আগে থেকে চালু টার্মিনাল সচল থাকলেও তাতে সরবরাহ করার মতো এলএনজি নেই। বিকল টার্মিনাল সচল করার কাজ চলছে।
চট্টগ্রাম জুড়ে গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ আকস্মিকভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কেজিডিসিএল’র বিপণণ বিভাগের উপ মহাব্যবস্থাপক (দক্ষিণ) প্রকৌশলী অনুপম দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, এলএনজি টার্মিনালে টেকনিক্যাল ফল্টের কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি, দ্রুততার সঙ্গে এ সংকটের সমাধান হবে।
আকস্মিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গৃহস্থালি খাতের গ্রাহকেরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন। কেজিডিসিএল’র প্রকৌশল ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল ছাড়া বিকল্প কোনো উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভাসমান দুটি টার্মিনাল থেকে পাওয়া প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়মিত গ্রাহকদের সরবরাহ করে থাকে কেজিডিসিএল।
এর মধ্যে একটি টার্মিনাল জরুরি সংস্কার কাজের জন্য গত অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য গত ৩ মাসেরও বেশিসময় ধরে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৭ জানুয়ারি সেটি ফেরত এসেছে। সেটি পুন:স্থাপন করতে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে সরবরাহে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে।
কেজিডিসিএল’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয় শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড ও কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানিকে। এ তিনটি খাতে গ্যাসের প্রয়োজন প্রায় ১২০ থেকে ১২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আরও ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাকি গৃহস্থালি ও শিল্পখাতে সরবরাহ করে কেজিডিসিএল।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে গৃহস্থালির পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্প কারখানা, সিএনজি স্টেশন, হোটেল-রেস্টুরেন্টেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে।
যা জানাল মন্ত্রণালয় :
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তরের টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। শুক্রবার দুপুরে মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কারণ জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি রূপান্তরের একটি ভাসমান টার্মিনালে (এলএনজি এফএসআরইউ) কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত মেরামতের কাজ করছে মন্ত্রণালয়।
এদিকে, রান্নার গ্যাস ছাড়াও সিএনজি, শিল্পকারখানা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট।
ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অর্থনীতির জন্য ৫টি ঝুঁকির মধ্যে জ্বালানি স্বল্পতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণ নিজস্ব জ্বালানির উৎপাদন কমেছে আর আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে।
জ্বালানি সংকট কতটা :বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, শিল্প, সার গৃহস্থলি, সিএনজিসহ সাতটি সেক্টরে মোট চাহিদা দাঁড়াবে ৩,৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
পেট্রোবাংলার হিসেবেই বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাসের ঘাটতি আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসের ঘাটতি আরো বেশি যা দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলছেন দিনে দিনে আমাদের উৎপাদন কমে আসছে। উৎপাদন বাড়ানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল তাতে কিছু জায়গায় উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু অন্য জায়গায় কমে গিয়ে নেট উৎপাদন কমে গেছে। আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা স্থবিরতা আছে। এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নাই। এই জ্বালানি সংকট যেটা সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নাই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক তামিম।
উদ্বেগ কোথায় :
বাংলাদেশে গ্যাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পেট্রোবাংলার হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদাই হবে এবার দেড় হাজার মিলিয়ন ঘটফুটের মতো।
তবে উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক চাহিদা হলো ২২৪০ এমএমসিএফডি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে সাড়ে সাতশ-আটশ এমএমসিএফডি গ্যাস।
অর্থাৎ গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের যে চাহিদা রয়েছে সেটির বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো।