ডেস্ক রিপোর্ট : সিলেট নগরীতে ছোট বড় নানাবিধ সমস্যা যেন শেকড় গেড়ে বসে আছে। জলাবদ্ধতা, যানজট, সড়কে খুঁড়াখোঁড়ি, অবৈধ গাড়ি স্ট্যান্ড, ফুটপাত দখল, রাস্তা জুড়ে হকারদের পশরা সাজানো এসব কারণে নগরবাসী এক অস্বস্থিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
আধুনিক জীবনের পরিবর্তে দুর্ভোগের সাথেই বসবাস করছেন তাঁরা। প্রখর রোদ খরতাপের পর যখন স্বস্থির বৃষ্টির জন্য উন্মুখ থাকেন মানুষ তখন বৃষ্টি নামে ঠিকই তবে বৃষ্টি হয়ে উঠে নাগরিকদের বিপদের কারণ। তখন স্বস্থির বদলে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে হিমশিম খেতে হয় তাদের। অর্ধেক রাস্তা জুড়ে অবৈধ স্ট্যান্ড, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, শৃঙ্খলা না মেনে যানবাহন চলাচলের কারণে নগরীতে অসহনীয় যানজটের কারণে পথচারী চলাচলেও দেখা দেয় সমস্যা।
সিলেট নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আদালতপাড়া, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নগর ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের বাস ভবনের সামনের সড়ক। এ সড়ক দিয়ে চলাচলে হিমশিম খেতে হয় যাত্রী সাধারণও পথচারীদের। বিশেষ করে ছুটির দিন ছাড়া আদালতের ফটক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ফটক দিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করা বা হেঁটে রাস্তা পার হয়ে আদালত প্রাঙ্গণে যাওয়া যেন এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এলোমেলোভাবে যানবাহন চলাচল, ট্রাফিক আইন অনুসরণ না করায় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কসহ নগরীর বিভিন্ন সড়ক বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন বিচারক, আইনজীবী, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাসহ সেবা প্রত্যাশীরা আদালতে আসেন কিন্তু রাস্তায় শৃঙ্খলার অভাবে অনেক সময়ক্ষেপন করতে হয় তাঁদের। এতে বিব্রতবোধ করেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পদস্থ কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবীসহ অন্যান্য মানুষজন।
অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে যোগ দেওয়াও সম্ভব হয় না তাঁদের। গুরুত্বপূর্ণ এসব ভবনের সামনের রাস্তায় রিকশা, অটোরিকশার স্ট্যান্ড, অবৈধ পার্কিং, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, হকারদের দৌরাত্মের কারণে এ অবস্থার সৃস্টি হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজ চালাতে গিয়ে সময়ে অসময়ে রাস্তাঘাট খুঁড়াখোঁড়ি, এলামোলোভাবে নির্মাণ সামগ্রী, ময়লা আবর্জনা আর মাটি রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখায় কাদামাটিতে চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় জনসাধারণকে।
সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন অলিগলিতে বিচ্ছিন্নভাবে চলে উন্নয়নকাজ। যে স্থান বা সড়কে কাজ চলার কারণে চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সেখানের রাস্তায় টানানো হয় না সতর্কতা সাইনবোর্ড। যে কারণে না জেনে অনেক মানুষ সে রাস্তা দিয়ে গিয়ে বিড়ম্বনার মুখে পড়েন।
নগরীতে উন্নয়নের নামে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সমস্যা দূর হওয়ার পরিবর্তে উল্টো বাড়ছে আরও ভোগান্তি। এজন্য সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই দায়ি করছেন বিশিষ্টজনেরা। আর ভোগান্তি লাঘবে একেক সময় একেক ধরণের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা। বেশ কিছুদিন আগে নগরীর রাস্তায় রিকশা লেন তৈরী করা হয়।
তাছাড়া রাস্তার মাঝখানে লোহার খুটি দিয়েও রাস্তাকে দুইভাগ করা হয়। কিন্তু তাতে বিড়ম্বনা আরও বাড়ে। চলে ভাঙা গড়ার খেলা। একবার নির্মান করা হয় আবার তা ভেঙে ফেলা হয়। সঠিক পরিকল্পনা যেন মাথায় আসছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
আকাশে মেঘ দেখলেই এখন শিউরে ওঠেন সিলেট নগরবাসী। এই বুঝি নামলো ঝুম বৃষ্টি। আর কয়েক মিনিটের ভারী বর্ষন মানেই তো বাসা-বাড়ি, দোকানপাট, রাস্তাঘাটে হাঁটু পানি। অথচ ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ছড়া-খাল উদ্ধার ও সংস্কার, ড্রেনেজ নির্মাণসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা।
কিন্তু হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত হতে পারেননি নগরবাসী। উল্টো বৃষ্টি হলেই পানিতে ভাসতে হচ্ছে তাদেরকে। এজন্য জলাবদ্ধতা নিরসনে অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নকে দায়ি করছেন সচেতন মহল।
জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে নগর কর্তৃপক্ষও একেক সময় একেক কথা বলছেন। গত মে ও জুলাই মাসে সিলেট নগরীতে ভয়াবহ বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দিলে ওই সময় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এর কারণ হিসেবে সুরমা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ি করেছিলেন। সুরমা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় নগরীর ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু সুরমা নদীর পানি নামার পরও বৃষ্টি হলে নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে বোল পাল্টান মেয়র ও প্রকৌশলীরা। তখন বিভিন্ন স্থানে ড্রেনের নির্মাণ কাজ ও নির্মাণাধীন ড্রেনে ঠিকাদাররা নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখাকে দায়ী করেন তারা।
একপর্যায়ে তারা জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে বৃষ্টিপাত ও ছড়া-খালে নাগরিকদের ময়লা আবর্জনা ফেলাকেই চিহ্নিত করেন। এ নিয়ে নগরভবন কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক সমালোচনায়ও পড়তে হয়।
এদিকে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সিলেট নগরীর যানজট। বেশ কয়েক বছর আগেই নগরী থেকে তুলে দেয়া হয়েছে ইজিবাইক। ব্যাটারিচালিত রিকশাও নগরীর সড়কে নিষিদ্ধ। সড়কের উপর চাপ কমাতে কোর্টপয়েন্ট থেকে চৌহাট্টা ও বারুতখানা থেকে জল্লারপাড় ব্যস্ততম এসব সড়কে প্যাডেল চালিত রিকশাও তুলে দেয়া হয়েছে।
প্রায় ৬ ফুট করে রাস্তাও প্রশস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও কমেনি যানজট। উল্টো দিন দিন অসহনীয় হয়ে ওঠছে যানজট। যানজট বৃদ্ধির জন্যও নগরবাসী অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ি করছেন।
তাদের মতে, উভয় পাশে সড়ক ৩ ফুট করে প্রশস্ত করা হলেও সড়কে যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা কোন লেন তৈরি হয়নি। ফলে সড়কে যানবাহনের চাপ কমছে না। এছাড়া অবৈধ পার্কিং ও হকারদের দৌরাত্ম বন্ধ করতে সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হওয়ায় যানজট বেড়েই চলছে।
অপরদিকে, উন্নয়ন কাজের নামে সারাবছর নগরীর রাস্তাঘাটে চলে খুঁড়োখুড়ি। একটি কাজ শুরু হলে সেটি ফেলে রাখা হয় বছরের পর বছর। এতে একদিকে যেমনি যান ও জন চলাচলে বিঘœ ঘটে, তেমনি ধুলোবালির কারণে মানুষ নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শুষ্ক মৌসুমে পুরো নগরীর পরিবেশ ধুলোর রাজ্যে পরিণত হয়। এনিয়ে নাগরিক সমাজ বিভিন্ন সময় প্রতিবাদী হলেও নগরভবন কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি।
এছাড়া উন্নয়ন কাজের জন্য নগরভবন কর্তৃপক্ষ নগরীকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্মাণাধীন অরক্ষিত ড্রেনে পড়ে আবদুল বাছিত মোহাম্মদ নামের একজন কবি ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালেও নগরভবন কর্তৃপক্ষের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
এখনো কোন ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে নগরীর রাস্তাঘাট, ড্রেন নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ। যে কারণে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতেই হচ্ছে।
নাগরিক বিড়ম্বনা প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, সিলেট নগরীর উন্নয়ন কাজগুলো একটি পরিকল্পনার অধীনেই হচ্ছে। ড্রেনেজ নির্মাণের কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে নগরবাসী মুক্তি পাবেন। যানজট নিরসনে সিটি করপোরেশন প্রায়ই হকার উচ্ছেদে অভিযান চালায়।
বেশিরভাগ রাস্তা ৬ ফুট করে প্রশস্ত করা হয়েছে, একটি পুরনো শহরে এরচেয়ে বেশি প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। এতটুকু প্রশস্ত করতে অনেকের দোকানপাট ভাঙতে হয়েছে। ঠিকাদারদের সবসময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে নির্মাণ কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের নিয়মিত তদারকিও রয়েছে। এরপরও মাঝে মধ্যে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যা খুবই দুঃখজনক।
শেয়ার করুন