ডেঙ্গু ঝুঁকিতে সিলেট!

সিলেট

দেশে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগী। গেল ২৪ ঘন্টায় দেশে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৬৫ জন ডেঙ্গুরোগী। এখন পর্যন্ত সিলেটে ডেঙ্গুরোগী পাওয়া না গেলেও নগরীর ৫টি পৃথক স্থানে মিলেছে এডিস মশার লার্ভা (ডেঙ্গু রোগের জীবাণু) শনাক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি নগরীর ২৫ ও ২৬নং ওয়ার্ডের ভার্থখলা, রেলওয়ে স্টেশন ও কদমতলী বাসস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এসব লার্ভা পাওয়া যায়। এদিকে মঙ্গলবারও নগরীর কয়েকটি স্থানে পাওয়া গেছে এডিস মশরার লার্ভা। ফলে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট।
জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া নতুন নয়। প্রতিবছরই এমন লার্ভা পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয়ভাবে সিলেটে ডেঙ্গু ছড়ানোর নজির খুব একটা নেই। গেল বছরও সিলেটের প্রথম শনাক্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ঢাকা থেকে অসুস্থ হয়ে সিলেটে এসেছিলেন। ফলে চলতি বছরেও দূরপাল্লার যানবাহনে যাতায়াতকারীরা ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রতিদিন সিলেট থেকে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে থাকেন। আকাশ পথ, রেলপথ ও সড়কপথে যাতায়াত করা এসব মানুষ এডিস মশার জীবাণু বহনের ঝুঁিকতে রয়েছেন। দূরপাল্লার অনেক যানবাহনে নিয়মিত স্প্রে না করার অভিযোগ রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ও রেলে ডেঙ্গু মশার নিরাপদ আবাস স্থাপন করতে পারে। আর এসব যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীরা যেমন ডেঙ্গু আক্রান্তের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন, তেমনী উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেটও।
এদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৬৫ ডেঙ্গু রোগী। এ নিয়ে সারাদেশে মোট ৩২২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে নতুন আক্রান্ত ৬৫ জনের মধ্যে ৫১ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪ জন। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩২২ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪৭ টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৪৬ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৭৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ১ জানুয়ারী থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ২ হাজার ৮১২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২ হাজার ৪৭৮ জন। এখন পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৩৬১ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ হাজার ১১১ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ৪৫১ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৬৭ জন।
জানা গেছে, চলতি বছরে গত ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম ১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারি চলাকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১-এ সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীর ২৫ ও ২৬নং ওয়ার্ডের কিছু দোকানেই প্রতিবছর ডেঙ্গু মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এবারও তাই হয়েছে। সিসিকের ঐ দুটি ওয়ার্ডের ভার্থখলা, রেলওয়ে স্টেশন ও বাসস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অনেকগুলো টায়ারের দোকান রয়েছেন। গত রোববার রুটিন অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টিম এসব এলাকার ডেঙ্গুর জীবাণু শনাক্তের লক্ষ্যে কয়েকটি টায়ার ও স্যানেটারী দোকান থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে পরীক্ষায় এডিস মশার জীবাণু শনাক্ত হয়। গত কয়েক বছর টায়ার টিউবের দোকানে এডিসের লার্ভা মিললেও এবার এর ব্যতিক্রম হয়েছে। এবছর অধিকাংশ টায়ার টিউবের দোকানে লার্ভা পাওয়া যায়নি। তবে টানা ৩ বছর ধরে পাওয়ার পর এবারও স্যানেটারী টাইলসের কয়েকটি দোকানে এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। মঙ্গলবার ভার্থখলা এলাকার কয়েকটি স্যানেটারী ও টাইলসের দোকানে অভিযান চালিয়ে ৩টি দোকানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। সেসব লার্ভা ধ্বংস করা হয়েছে। সকল দোকানদেরকে বাইরে রাখা স্যানিটারী জিনিস ঘরের ভিতরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নগরীর বেশকিছু স্থানে এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার নগরীর ভার্থখলা এলাকার ৩ টি স্যানিটারী ও টাইলসের দোকানের বাইরে রাখা জিনিসপত্রে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। আমরা সেসব ধ্বংস করেছি। দোকান মালিকদের বলেছি খোলা আকাশের নিচ থেকে স্যানিটারী জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করা হবে।
তিনি আরো জানান, মঙ্গলবার যে ৩টি স্যানিটারী দোকানে লার্ভা পাওয়া গেছে এসব দোকানে গত টানা ৩ বছর থেকে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবছর তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী সময়ে নগরজুড়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলছে। এডিস মশার লার্ভা চিহ্নিত করতে অভিযান চলমান রয়েছে। শীঘ্রই মশক নিধনে বিশাল পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত শংকর দৈনিক জালালাবাদকে বলেন- দেশে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। তবে সিলেটে এখনো ডেঙ্গুরোগীর সন্ধান মিলেনি। আমরা ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার লার্ভা চিহ্নিত করতে কাজ করছি। যেসব স্থানে লার্ভা পাওয়া গেছে সেসব এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করে দিয়েছি। বাইরের যে কোনো স্থানে পরিস্কার পানি জমে থাকলে ডেঙ্গুর আশঙ্কা থাকে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যাতে কোথাও জমে থেকে এডিস মশার লাভা তৈরি না হয়।
তিনি বলেন- গেল বছরে গত জানুয়ারী মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত ৪ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সিলেটের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের সবাই ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সিলেটের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সব মিলিয়ে গত ৭ মাসে সিলেট জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ঐ ৪ জনই ছিলেন। তবে জানুয়ারীর পর থেকে সিলেটে আর কোন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ডা: হিমাংশু লাল রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটে এখনো কোন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়নি। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছি। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা চিহ্নিত ও ধ্বংস করা হচ্ছে। যেসব স্থানে লার্ভা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে সেসকল স্থানে ধারাবাহিক অভিযান অবাহত রয়েছে। সিলেটে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ছড়ানোর আশঙ্কা কম। তবে অন্যান্য জায়গা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সিলেটে আসার ঝুঁকিটাই বেশী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, সেখানে ২০২২ সালে মৌসুম পূর্ব জরিপে লার্ভার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জলমগ্ন ফ্লোরে লার্ভা বেড়ে ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, প্লাস্টিক বালতিতে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পানির ট্যাংকে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের চেয়ে এবার ডেঙ্গু প্রকোপ বেশি হওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ঐ বছর লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন।
পরের বছর ২০২০ সালে উচ্চমুখী করোনা পরিস্থিতির কারণে বাসা-বাড়ি ও সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেকাংশে কমে আসে। ওই বছর এক হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যান ১২ জন।
তবে গত বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত যখন করোনার ভয়াবহতা দেশব্যাপী ছাড়িয়ে পড়ে, তখন কোভিড রোগী ছাড়াও স্বাভাবিক চিকিৎসা অনেকটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। আর এতে করেই ডেঙ্গুতে প্রাণহানি বেড়ে যায়। ২০২১ সালে মারা যায় ১০৫ জন, আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার মানুষ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *