দুঃখ কষ্টে ভরা বেদেদের জীবনঃ বাইদ্যা নয় মানুষ হিসাবে পরিচয় পাক

সিলেট

ফারুক আহমদ
স্টাফ রিপোর্টার

এডমিরাল এমএ খান (লামাকাজী) সেতু সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজীতে সুরমা নদীর পশ্চিম পারে রাগীব রাবেয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পূর্ব-দক্ষিণে সুরমা নদীর পারে খোলা মাঠে অস্থায়ীভাবে ১০টি বেদে পরিবারে ৪০ জন মানুষের বসবাস।
কাঠফাটা রোদ আর তীব্র ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস তাদের। দুপুর বেলায় কাঠফাটা রোদের তাপে প্রাণটা দেহ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। বেদে পরিবারে জন্ম নেয়াই যেন তাদের আজন্ম পাপ।

শুক্রবার ২৯ সেপ্টেম্বর পড়ন্ত বিকেলে কথা হয় বেদেদের সঙ্গে। তারা জানান, দুঃখ ও কষ্ট গাঁথা জীবনের কাহিনি। সাদামাটা জীবনযাপন তাদের। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিটি দিন তারা কাটায়। একটু সুখের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কঠোর পরিশ্রম করে। এরা রহস্যময় মানুষ। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে।

স্থানভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্র্যসব পেশা। বেদেদের বাহন নৌকা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে নেয় এরা।

তাদের জীবন যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে, নাম না বলা এক বেদে নারী বলেন, তারা দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারে বেদে সম্প্রদায়। তাবিজ-কবজ বিক্রি, জাদুটোনা আর সাপ খেলা দেখিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় ছিন্নমূল, অসহায় বেদে সম্প্রদায়কে।

তারা রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে বা পরিত্যক্ত জমি, খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠের পাশে অথবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়ে। আবার একদিন উধাও হয়ে যায়, কেউ খবর রাখে না তাদের।
সময়ের আবর্তে উন্নতির পরিবর্তে বেদে সমাজের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই তারা অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদী। নদী ছেড়ে কোথায় যাবে এসব বেদে। তাদের নেই কোনো শিক্ষা, নেই কোনো কাজের বিশেষ যোগ্যতা।
এভাবেই বেদের জীবনের শেষ হয়ে যায়। বেদেরাই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ। নৌকাতেই তাদের জন্ম আর নৌকাতেই তাদের জীবন শেষ। বাংলাদেশ সরকার কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ যদি আমাদের একটু দেখতেন তাহলে আমরা খুবই ভালো করে জীবন অতিবাহিত করতে পারতাম, এমনটাই আক্ষেপের সুরে বললেন বেদে সরদার মো. আসাদুজ্জামান সেলিম।
স্হায়ী ঠিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন সুনামগন্জ জেলার সদর উপজেলার গৌড়ারং ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রাম থেকে এসেছেন ব্যবসার জন্য। ব্যবসা ভালো হলে কিছু দিন এখানে থাকবেন নতুবা অন্যত্র চলে যাবেন। এরকম কোন জায়গায় দশ দিন কোথাও এক মাস আবার কোথাও ছয় মাস অবস্হান করেন এসব বেদেরা।

বেদেদের জীবন অধিকারবিহীন। তাদের মৌসুমী শীত, ঝড়, তুফান, গরম বুকে ধারণ করা যে কত কষ্টকর একমাত্র তারাই বুঝে। বেদেদের বাড়ি-ঘর, মাথার ওপর ছাদ, সামাজিক মর্যাদা জন্ম থেকে আজও তারা বঞ্চিত ! কিন্তু কেন?
তারা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো পাশাপাশি টেঁটা দিয়ে মাছ শিকার, সিঙ্গা, তাবিজ, ছাতা, পুরোনো তালা মেরামত, কবজ, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো এই ছিল বেদে সম্প্রদায়ের গন্তব্যহীন রাজ্যের আস্তানায় বিভোর। রাস্তার ধারে, কখনও মেঠোপথের ধারে ও ফাঁকা মাঠে ছঁই বা ঝুপড়ি, মাচা, তুলে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে দিন-রাত কাটান।

এদেশে বেদেদের জাত প্রথার শিকার। বিশ্বে দাস প্রথা, বর্ণবাদ আজ বিলুপ্তির পথে বলা যায়। এই জাতের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা যা দরকার তা তাদের নেই। জাতের বড়াইয়ে মানুষ হলেও যাযাবর বাইদ্যা (বেদে) বলে গণ্য গাঁও- গ্রামে।
পাশাপাশি এই পরিবারের ছেলে-মেয়ে অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে। শিশু-কিশোররা স্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো মেধাসম্পূর্ণ হলেও বেদের ঘরে জন্ম নেয়াই হলো পাপ। তা না হলে তাদের ক্লাস করা কষ্ট হয় কেন ? কী নির্মম নির্দয় এই সমাজব্যবস্থা।

দু’বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারলেই আমরা মহাখুশি। স্বামীর, স্ত্রী সাংসারিক জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়াই গাঁও-গ্রামে। কপালের টিপ, চুড়ি, থালা-বাসন বিক্রি ও সাপ খেলা ও বানরের নাচ দেখিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে সংসার জীবন চলে।

তারা বলেন, বেঁচে থাকার নাম সংগ্রাম। আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না, আমরা যাযাবর এটাই লোকমুখে আখ্যায়িত। স্বামী-স্ত্রী যখন জীবিকার সন্ধানে ছুটে যান তখন শিশু-ছেলে-মেয়েরা পাখির মতো বন্দিশালার দৃশ্য অবাক হওয়ার মতো। কিভাবে অসহায়ের মতো পথ পানে চেয়ে থাকে।
মা-বাবার স্নেহ কখন মিলবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় এই সোনামণিদের। তীব্র গরমে সীমাহীন ভোগান্তি, অনাদর অবহেলায় রোগ ব্যাধিতে নিঃশেষ হয়ে যায়। এদের পাশে থাকে না সমাজের কোনো ধনী শ্রেণি, থাকে না প্রশাসনের দৃষ্টি।
এই বেদে পরিবারের শিশুরা সব সময় পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
তাদের সন্তানরা অন্য ৮-১০ জনের মতো লেখাপড়া শেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। তখন হিমশিম খেতে হয় মা-বাবার। যদি সরকারের সুদৃষ্টি থাকে তাহলে সম্ভব।

ওদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রকৃতির লতাপাতা, গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে রোগ নিরাময় করে থাকেন।

আক্ষেপ করে এক বেদে বলেন, ১০ জনের মতো বেদে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছি। সরকার যদি আমাদের একটু খাস ভূমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিত তাহলে প্রাণে বেঁচে যেতাম।
বেদে (বাইদ্যা) হিসেবেও নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়ে থাক এটাই আমার আশা-এটাই আমার প্রত্যাশা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *