নির্বাচন কমিশনের ‘কাঁচা মিথ্যা’ দেখিয়ে দিলো আগামী নির্বাচনের কৌশল

মুক্তমত

যেখানেই যাই ঘুরে-ফিরে সেই একই প্রশ্ন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে প্রশ্নের সংখ্যা। নির্বাচন কি আদৌ হবে? হলে কেমন হবে সেই নির্বাচন? বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কি অংশ নেবে নির্বাচনে? সরকার কি দেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার? যদি সরকার পদত্যাগ না করে তাহলে কি নির্বাচনে যাবে বিএনপি? মানুষ কি পারবে ভোট দিতে? ন্যূনতম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া যদি কোনও নির্বাচন হয় তাহলে সেটি ২০১৪ বা ১৮ সালের নির্বাচনের মতোই হবে নাকি?

সেই ধরনের প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির কী লাভ? গত ১৭ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরাজনীতিকরণের যে চেষ্টা আমরা দেখেছি, দেখেছি ভিন্নমত দমন করে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম করা, সেখান থেকে দেখলে এই প্রশ্নগুলো এখনও আশাবাদী করে আমাকে। সাধারণ মানুষের এখনও আগ্রহ আছে রাজনীতির প্রতি, স্থানীয় থেকে জাতীয় প্রতিটি নির্বাচনে বারবার প্রতারিত হওয়ার পরও মানুষ প্রত্যাশা করে, দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, যেখানে ভোট দিতে পারবেন মানুষ।

বলা হয়, এই মাটিতে দলীয় সরকারের অধীনে একটাই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল, আর সেটি হয়েছিল ১৯৫৪ সালে, যেখানে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে ভূমিধস বিজয় পায় যুক্তফ্রন্ট। স্বাধীনতার পর যে চারটি নির্বাচন মোটা দাগে সর্বমহলের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল সেগুলো হল ৯১, ৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এর নির্বাচন। এর প্রত্যেকটি হয়েছে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই ধরনের সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজনের জন্য আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় জামায়াতকে সাথে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেছে, সংসদ বর্জন করেছে। যাক, সেই আলোচনা যদি আপাতত সরিয়েও রাখি, তারপরই প্রশ্ন ওঠে এই কমিশন কি পারবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে? বিশেষ করে যখন পরপর দুই মেয়াদ নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থেকে যাওয়া সরকারটি একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকবে, সেই সাহস কিংবা সামর্থ্য কোনোটিই রাখে না। তাই আসন্ন সংসদ নির্বাচনটিও কোনও না কোনোভাবে কারসাজি করে ক্ষমতায় থেকে যাবার ছক যে আঁটছে সরকার, সেটি বুঝবার জন্য রাজনৈতিক বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার পছন্দসই পন্থায় ক্ষমতায় থাকার পথে সরকার কৌশলগতভাবে ভুল করে যাচ্ছে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনকালীন, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবির জবাবে বরাবরের মতোই সংবিধানকে ধর্মগ্রন্থের মতো করে উপস্থাপন করে, সংবিধানের দোহাই দিয়ে, আদালতকে সামনে এনে সরকার সেটা বারবার নাকচ করছে। অর্থাৎ সরকার চাইছে তারা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়, এমনকি ৩০০ আসনের এমপিরা সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় সংসদ নির্বাচন হবে। সরকারের বয়ান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, তাই তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে কোনও বাধা নেই। আর সরকারি বয়ান মতে ক্ষমতাসীন সরকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য ‘সুবোধ বালকে’র মতো নির্বাচন কমিশনকে সব রকম সহায়তা দিয়ে যাবে।

নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের যে বয়ান তাতে অত্যাবশ্যক বিষয় হচ্ছে অত্যন্ত নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকা। তবে একটা অসাধারণ শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দেখলেও বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, সেটা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। এমনকি বিএনপি এভাবেও বলেছে যে বিএনপির নেতাদের নিয়ে একটা নির্বাচন কমিশন তৈরি করলেও সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারবে না, তাই বিএনপি তেমন কোনও কমিশনের অধীনেও নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু সরকারের তারপরও উচিত ছিল তাদের বয়ানের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে চমৎকার নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা। কিন্তু গঠিত হওয়ার পর থেকেই নির্বাচন কমিশন একের পর এক যা করছে, তাতে নির্বাচনের সোয়া এক বছর আগেই মানুষের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে তারা।

দায়িত্ব নিয়েই যে সিইসি নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে পাওয়ার জন্য বিএনপিকে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো নির্বাচন নামের যুদ্ধের ময়দানে থাকতে বলেন, সেই কমিশন মানুষের ন্যূনতম আস্থা পাবেন, এটা হবার কোনও প্রশ্নই আসে না। কমিশনের এই বক্তব্যের মাধ্যমেই এটা একেবারে স্পষ্ট যে তিনি নির্বাচনকে মনে করেন একটি মল্লযুদ্ধ, যেখানে শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতার ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করে। এরপর সিইসিসহ পুরো নির্বাচন কমিশন এমন সব কথা বলেছে, এমন সব আচরণ করেছে, যাতে খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝে ফেলা যায়, কমিশনটি প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ফেলছে সরকারের সাথে পরামর্শ করে। সেটা কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় এমপিকে এলাকায় থাকতে দিয়ে নাকে খত দেওয়া, সেই নির্বাচনে হঠাৎ ফল ঘোষণা বন্ধ করে দিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ সরকারি দলের ইচ্ছায় সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হবার মতো আসনে (১৫০) ইভিএমে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে প্রমাণিত হয়।

দেশের মানুষ অনেক দিন থেকেই অনুমান করেন, আগামী নির্বাচন নিশ্চয়ই আগের দুইবারের মতো পদ্ধতির কোনও একটিতে হবে না, হবে নতুন কিছু। অনেকেই দীর্ঘদিন থেকেই অনুমান করেছেন, এবার হবে ইভিএমের কারসাজির মাধ্যমে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে প্রযুক্তি সারা পৃথিবীতে গ্রহণ করেছিল হাতে গোনা কয়েকটি দেশ, আবার যেটা থেকে ভারত, ব্রাজিল আর ভুটান ছাড়া বেরিয়ে এসেছে সবাই, সেই প্রযুক্তি নিয়ে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ এই সন্দেহকে যৌক্তিকতা দিয়েছে।

সম্প্রতি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এই রোডম্যাপের সরবরাহকৃত পুস্তিকার প্রধান অংশই হচ্ছে ইভিএমকে যৌক্তিকতা দেওয়ার বয়ান। এবং এই যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য  নির্বাচন কমিশন যা করেছে, সেটা একেবারে শিশুতোষ কাঁচা মিথ্যা। মিডিয়ার মাধ্যমে একেবারে জনপরিসরে প্রকাশিত তথ্য নিয়ে এমন ‘কাঁচা মিথ্যা’ কেউ বলতে পারে দেখে স্তম্ভিত হতে হয়।

ইসি প্রকাশিত পুস্তিকায় বলা হচ্ছে, গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে, এরমধ্যে ১৭টি দলই কোনও না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে ছিল। সরাসরি ইভিএমের পক্ষে ছিল ১২টি দল। কিন্তু সংলাপে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইসি যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলে প্রচার করেছে, তার মধ্যে ৩টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে। ১টি দলের ইভিএম নিয়ে কোনও মতামত ছিল না। আর ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা বলেছিল। সরাসরি ইভিএমের পক্ষে অবস্থান ছিল মাত্র চারটি দলের। এই চারটি দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ, তরীকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল ও বিকল্প ধারা। এরমধ্যে তরীকত ফেডারেশন ও সাম্যবাদী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। আর  বিকল্প ধারার সঙ্গে এক ধরনের নির্বাচনি সমঝোতা ছিল গত সংসদ নির্বাচনে।

ইসি কর্মপরিকল্পনায় দাবি করেছে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সরাসরি ইভিএমের পক্ষে। কিন্তু গত ১৮ জুলাই দলটি সংলাপে ইসিকে যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে তারা ইভিএমের সরাসরি বিরোধিতা করেছিল। দলটি ইসির কাছে যেসব প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে ইভিএম প্রসঙ্গে বলা হয়, ইভিএম মেশিনে নয়, বরং স্বচ্ছ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসি এই দলের অবস্থান নিজেদের মতো করে পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।

ইসি তাদের কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। ১৯ জুলাই সংলাপে অংশ নিয়ে দলটি ইসিকে যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানে ইভিএমের বিষয়ে কিছু ছিল না; বরং তাদের প্রস্তাব ছিল ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে করা’।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাল্টে দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান (সিইসি অসুস্থ থাকায় এখন তিনি সিইসির দায়িত্বে) এবং মো. আলমগীরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে একটি জাতীয় দৈনিক। কিন্তু তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শেষ দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।

শেষ করছি আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে। ইসির রোডম্যাপ ঘোষণার দিন এক স্বনামধন্য চ্যানেল আমাকে প্রশ্ন করলো, আমি যে বলছি বেশিরভাগ দল ইভিএমের বিপক্ষে কিন্তু ইসি তো বলছে ২৯টি দলের মধ্য ১৭টিই ইভিএমের পক্ষে। আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। কারণ, আমার মনে ছিল সংলাপের সময় বেশিরভাগ দলই ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে; এমনকি সিইসি পর্যন্ত এ বিষয়ে বলেছেন। তবে মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি ইসি এমন ‘কাঁচা মিথ্যা’ বলতে পারে। ইভিএম নিয়ে এই ‘কাঁচা মিথ্যা’ই প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন ইভিএমে করতে মরিয়া। আর এই মরিয়া হওয়া প্রমাণ করে আগামী নির্বাচনে খেলায় জয় নিশ্চিত করা হবে ইভিএমে কারসাজি করে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *