সালামের প্রচলন সম্প্রীতির সম্প্রসারণ -মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার

মুক্তমত

ইসলাম হলো শাশ্বত সুন্দর ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি। সর্বত্র স্বস্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য মাধ্যম। সেই সুমহান আদর্শের একটি বিশেষ নিদর্শন হচ্ছে পারস্পরিক সালাম বিনিময়। সালামের মতো অর্থবহ, আকর্ষণীয় ও প্রশান্তিময় সম্বোধন আর কিছু হতে পারে না। মুসলিম হিসেবে আমরা এর পক্ষাবলম্বন করছি কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে যাচ্ছি; ব্যাপারটি এরকম নয়। নিরপেক্ষ গবেষণা ও পর্যালোচনা করলেও এই তথ্য সুনিশ্চিত হবে, সন্দেহ থাকবে না; ইনশা আল্লাহ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সালামের ব্যাপক প্রচলন প্রত্যাশা করতেন। নিজেও সেই আমল করেছেন। এমনকি ছোট্ট শিশুদের পর্যন্ত তিনি সালাম করতেন। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি কিছুসংখ্যক শিশুর নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন এবং বললেন, ’রাসুলুল্লাহ (সা.) এরূপ করতেন।’ [বুখারী: ৬২৪৭, মুসলিম: ২১৬৮]।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সালামের ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আয়াতে কারীমার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন- সূরা নূরের ৬১ নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন: “যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এ হবে আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন।” এই আয়াতে নিজ ঘরে প্রবেশের কিছু আদব কায়দা বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হলো এই যে, প্রবেশের সময় বাড়ির লোকদেরকে সালাম দাও। মানুষ নিজের স্ত্রী-সন্তানদের উপর সালাম করা বোঝা বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তির জন্য জরুরী আল্লাহর আদেশ পালন করে সালাম দেয়া। নিজের স্ত্রী-সন্তানদেরকে শান্তির দোয়া দেয়া থেকে কেন বঞ্চিত রাখা হবে?

একইভাবে অন্য লোকদের বাসা বাড়িতে প্রবেশের সময় অনুমতি নেয়া ও সালাম দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা একই সূরার ২৭ নং আয়াতে জানিয়ে দিয়েছেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ব্যতীত অন্য কারো ঘরে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।” তাফসীরে আহসানুল বায়ানের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, আলোচ্য আয়াতে গৃহ-প্রবেশের অনুমতি নেয়ার কথা আগে এবং সালাম দেয়ার কথা পরে উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু হাদীস হতে জানা যায় যে, নবী (সা.) প্রথমে সালাম দিতেন এবং পরে প্রবেশ করার অনুমতি নিতেন। অনুরূপ মহানবী (সা.)-এর এও অভ্যাস ছিলো যে, তিনি তিন তিনবার অনুমতি চাইতেন। অতঃপর কোন উত্তর না পেলে তিনি ফিরে যেতেন। নবী (সা.)-এর বরকতময় এ অভ্যাসও ছিলো যে, অনুমতি চাওয়ার সময় দরজার ডানে অথবা বামে দাঁড়াতেন এবং একেবারে সামনে দাঁড়াতেন না যাতে (দরজা খোলা থাকলে অথবা খোলা হলে) সরাসরি ভেতরে নজর না পড়ে। [বুখারী: ইসতি’যান অধ্যায়, আহমদ ৩/১৩৮, আবু দাউদ: আদব অধ্যায়]। অনুরূপ তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি মারতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি বাড়ির ভেতরে যে উঁকি মারে সে ব্যক্তির চোখ বাড়ির লোক নষ্ট করে দিলেও তার কোন অপরাধ নেই। [বুখারী: দিয়াত অধ্যায়, মুসলিম: কিতাবুল আদাব]। মহানবী (সা.)-এর এটাও অপছন্দ ছিলো যে, ভেতর থেকে বাড়ির মালিক ‘কে তুমি?’ জিজ্ঞাসা করলে, তার উত্তরে নাম না বলে কেবল ‘আমি’ বলা। অর্থাৎ, ‘কে’ জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে নিজের নামসহ পরিচয় দিতে হবে। [বুখারী: ইসতে’যান অধ্যায়, মুসলিম: আদাব অধ্যায়]।

সালামের ব্যাপক প্রচলন ঈমানী দায়িত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ’আস (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলো, ’সর্বোত্তম ইসলামী কাজ কী?’ তিনি বললেন, “(ক্ষুধার্তকে) অন্নদান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে।’’ [বুখারী: ১২, ২৮, ৬২৩৬; মুসলিম: ৩৯]। হযরত আবু উমারা বারা ইবনে আযিব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ’রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সাতটি (কাজের ব্যাপারে) আদেশ করেছেন: ১. রোগী দেখতে যাওয়া, ২. জানাযার অনুসরণ করা, ৩. হাঁচির জবাব দেয়া, ৪. দুর্বলকে সাহায্য করা, ৫. নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্য করা, ৬. সালাম প্রচার করা, এবং ৭. শপথকারীর শপথ পূরণ করা।’ [বুখারী: ১২৩৯, ২৪৪৫, ৫১৭৫, ৫৬৩৫, ৫৬৬০, ৫৮৩৮, ৫৮৪৯, ৫৮৬৩, ৬২২২, ৬২৩৫, ৬৬৫৪, মুসলিম: ২০৬৬]।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ’’তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা গড়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলে দেবো না, যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসতে লাগবে? (তা হচ্ছে) তোমরা আপোসের মধ্যে সালাম প্রচার করো।’’ [মুসলিম: ৫৪, তিরমিযী: ২৬৮৮, আবু দাউদ: ৫১৯৩]।

পারস্পরিক পরিচিতি, সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বাড়ানোর জন্য সালামের ব্যাপক প্রচলন অনস্বীকার্য। মু’মীন হৃদয়ে ঠাঁই পেতে সালাম কার্যকরী একটি আমল। যা দূরের মানুষকে কাছে নিয়ে আসে। সম্পর্কের দূরত্ব তৈরী হলে, তা কমিয়ে দেয়। ভ্রাতৃত্ববোধকে অন্তরে সদা জাগরূক রাখে।

[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *