সনির কো-ফাউন্ডার Masaru Ibuka গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। বিশেষ করে লন টেনিস খেলার সময়। দীর্ঘ বিমানযাত্রার সময়ও নিজের পছন্দের গানগুলো শুনতে চাইতেন। কিন্তু তখনকার টু বা থ্রি ব্যান্ড রেডিও সঙ্গে বহন করা মোটেই সহজ ছিল না। তাছাড়া স্বল্প সময়ে তার ব্যাটারিও শেষ হয়ে যেত। পাশাপাশি আরেকটা সমস্যা তাকে বেশ পীড়িত করে। সেটা হলো তার ছেলেমেয়েরা ক্যাসেট প্লেয়ারে উচ্চস্বরে রক মিউজিক শুনত, যা তার রুচির সঙ্গে যায় না।
এ সমস্যাগুলোর ধরন এবং তা থেকে উত্তরণে কী করা যায়, তা সহকর্মী আকিও মরিটার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আলাপ করতেন। আমরা যেমনটা পাশের বাসার ছাদে তরুণদের উচ্চস্বরে মিউজিক বাজানোর ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করি, অনেকটা সে রকম। তবে সেগুলোর কোনো সমাধান তিনি আশা করতেন না। কারণ নিতান্তই কথার কথা হিসেবে তিনি ওই বিষয়গুলো ব্যবসায়িক পার্টনারের সঙ্গে শেয়ার করতেন।
কিন্তু Akio Moritaর মাথায় ধীরে ধীরে সেগুলো গেঁথে যায়। তিনি চলতে-ফিরতে ভাবতে থাকেন কীভাবে তার সহকর্মীকে সাহায্য করা যায়। হঠাৎ তার মাথায় আসে আচ্ছা, ছোট্ট একটা ডিভাইসে যদি প্রত্যেকের নিজস্ব পছন্দের গান শোনার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তার নিজের ইচ্ছাও পূরণ হবে অন্যদিকে আশপাশের মানুষও বিরক্ত হবে না। অনেকটা কবিগুরুর ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার মতো।
ব্যস, যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি সনির ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে বসলেন। সমস্যাগুলো তুলে ধরলেন। কীভাবে এর সমাধান হতে পারে তার প্রাথমিক ভাবনাগুলোও শেয়ার করলেন। রেডিও বিষয়ে দক্ষ প্রকৌশলীরা খুব শিগগিরই একটা মডেল দাঁড় করালেন। ডেমো হলো শুধু সনির দুই কর্ণধারের সামনে। তারা আরো কিছু ভ্যালু অ্যাড করার পরামর্শ দিলেন। পণ্যটির সফলতার ব্যাপারে তারা খুবই আশাবাদী হলেন।
এই প্রথম সনি নতুন একটি পণ্য তৈরি করতে যাচ্ছে যার কোনো মার্কেট রিসার্চ হয়নি। সাধারণ ক্রেতাদের প্রত্যাশা শোনা হয়নি। কোনো পাইলট টেস্টিং হয়নি। সরাসরি উৎপাদন ও বাজারজাত নিঃসন্দেহে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৯৭৯ সালের জুলাইয়ে ৩০ হাজার ইউনিট ওয়াকম্যান তৈরি করা হয়। প্রথম মাসে বিক্রি হয় মাত্র তিন হাজার!
তখন প্রথা ভেঙে এ পণ্যটির প্রেস ডেমো করা হয় এক পার্কে। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা হেডফোন কানে লাগিয়ে হেঁটে হেঁটে মিউজিক উপভোগ করার সুযোগ পান। এমনকি সনি কর্তৃপক্ষ কিছু তরুণকে নিয়োগ করেছিল যারা রাস্তায় বাইসাইকেল চালানোর সময় ওয়াকম্যানে গান শুনতে থাকবে। আশপাশের কেউ আগ্রহী হলে তাকেও সেই অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য আহ্বান জানাবে। এখন যেমন দুই বন্ধু মাঝেমধ্যে একই ডিভাইস থেকে ইয়ারফোনের মাধ্যমে গান শেয়ার করে থাকে।
তাছাড়া কিছু তরুণকে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওয়াকম্যানে গান শুনতে পাঠায়। আসলে তারা ছিল কোম্পানি নিয়োজিত প্রমোশন কর্মী! এ কৌশলগুলো দারুণ কাজ করে। এখন যেমন ভাইরাল হয় তখন হতো ওয়ার্ড অব মাউথ! মানুষের মুখে মুখে পণ্যটির কথা ছড়িয়ে পড়ল।
জাপানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকের ফেরার সময় একটা ওয়াকম্যান কেনা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। তাদের দেশে ফেরার পর এ পণ্যটি পাওয়ার জন্য তরুণদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়। তারা নিজের পাশাপাশি প্রিয়জনের জন্য উপহার হিসেবে এটা কিনতে শুরু করে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্বের বড় বিপণিগুলো ওয়াকম্যানে ভরে যায়। পরবর্তী সময়ে তারা বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি ওয়াকম্যান বিক্রি করে!
আমরা নতুন পণ্যের ধারণা পেতে বড় যে ভুল করি তা হলো—ক্রেতারা কী চায়, তারা কী কী বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশা করে, নতুন পণ্যে তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে… তা অনুমান করে সেভাবে পণ্য উন্নয়নে চেষ্টা করি। কিন্তু ক্রেতারা কি সত্যিই জানে একটা পণ্যে কত ধরনের বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়া সম্ভব? তারা তো এটা নিয়ে গবেষণা করে না। এমনকি আপনার নতুন পণ্যটি হাতে পাওয়ার আগে হয়তো এ বিষয়ে আলাদাভাবে কখনো চিন্তাও করে না। সে কারণেই সনি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা Akio Morita বলতেন, Our plan is to lead the public with new products rather than ask them what kind of products they want.
তাছাড়া একবার ভাবুন, ক্রেতারা এরই মধ্যে যেটা কল্পনা করতে পারছে বা চাওয়া সুস্পষ্ট—পণ্যে সে বৈশিষ্ট্য পেলে তারা আপাতত খুশি হবে। কিন্তু তারা চমকে উঠবে না, পুলকিত হবে না! আর বিস্ময় জাগাতে না পারলে আলোচনায় আসবে না। বিশেষভাবে নজর কাড়বে না।
হয়তো সে কারণেই গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে প্রত্যেক সেলিব্রেটির টার্গেট থাকে এমন একটি পোশাক পরা যাতে উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে। হাজারও তারকার মাঝে মিডিয়া যেন তার উপস্থিতিকে আলাদাভাবে গণ্য করে! আন্তর্জাতিক এসব অনুষ্ঠানে সুপারস্টারদের পোশাক নিয়ে অতি আগ্রহ অনেকের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। কিন্তু আমরাও কি শৈশবে ঈদের জামা কিংবা জুতা লুকিয়ে রাখতাম না? আপনি কেন সেটা করতেন? অন্যদের দেখালে কী ক্ষয় হয়ে যেত? না, সেটা হতো না। তবু সেটা করতেন। কারণ ঈদের দিন সকালে সবাইকে চমকে দিতে চাইতেন, তাই না?
যা হোক, প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির বদৌলতে আমরা এরই মধ্যে নানা ধরনের স্ক্যানারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি কিন্তু আপনি কি জানেন, সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে স্ক্যানার দিয়েছেন তার তুলনীয় এখনো কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি! কারণ মাতৃগর্ভে হূত্স্পন্দন শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা সচেতন বা অচেতনভাবে আমাদের চারপাশকে প্রতিনিয়ত স্ক্যান করতে থাকি। আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় এ কাজে সাহায্য করে। তবে তার বাইরেও কিছু বিষয় আমরা বুঝি যা ব্যাখ্যাতীত। তাকে ‘সিক্সথ সেন্স’ বলা হয়। মানুষ এগুলোর সাহায্যে প্রতিনিয়ত চারপাশকে স্ক্যান করে। এমনকি এখন তার যা দরকার নেই সে বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ ও মজুদ করে। কী বিশ্বাস হচ্ছে না?
আপনার পাশে যদি কয়েকজন মানুষ থাকে তাদের সামনে হঠাৎ করে বলুন: আমলকী খেতে খুব ইচ্ছা করছে। কোথায় যে পাই? জাস্ট কথাটা তাদের উদ্দেশে ছুড়ে দেন। দেখবেন কত ধরনের তথ্য তারা আপনার সামনে হাজির করছে। অথচ তাদের কেউ কেউ হয়তো কখনো আমলকী মুখেই দেয়নি কিংবা কখনো নিজে কেনেনি। তাহলে তারা এত তথ্য জানল কেমন করে?
হয়তো সংবাদপত্রে এ বিষয়ে ফিচার পড়েছে কিংবা ফেসবুকে কোনো পোস্ট। না হলে ইউটিউবের ভিডিও। অথবা অন্যান্য ফল-সবজি কেনার সময় অন্যেরা দামদর করছিল, সেটা আড় চোখে দেখেছে। এর মানে হলো আমরা শুধু যে পণ্য কিনি তারই খোঁজখবর রাখি ব্যাপারটা তেমন নয়। বিশেষত সমাজের জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ বলে পরিচিত ব্যক্তিরা নানা বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। আজকাল সোস্যাল মিডিয়া এমন অসংখ্য বিষয়ে আমাদের সচেতনতার মাত্রা বাড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে অনেকে তাদের সব বিষয়ে মতামত দেয়াকে বাড়াবাড়ি মনে করে, বিরক্ত হয়।
তবে অন্যেরা এ লোকদের ওপর বিরক্ত হলেও একজন ব্যবসায়ীর কাছে কিন্তু তারা সম্পদ। কারণ বিনা খরচে তারা একেক ব্র্যান্ডের উকিল হিসেবে কাজ করে। তাদের ‘ওপিনিয়ন লিডার’ বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিন্তু তারা প্রকৃত ক্রেতার চেয়ে শক্তিশালী হন। অর্থাৎ যার পকেটের পয়সা যাবে তার কথা বা মতের চেয়ে মতামত প্রদানকারী ওই ব্যক্তির কথা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে! ফলে এমন লোকদের কনভিন্স করতে পারা বা সন্তুষ্ট রাখা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
এমন ব্যক্তিদের অনেকেই বাচাল ভাবে। কিন্তু তারা চুপচাপ, অতিশয় ভদ্রলোকের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি উপকারে আসে। কারণ লোকে কী বলবে এ ভয়ে চুপসে না থেকে তারা কথা বলেন। আর কথাগুলো যাদের বলেন তাদের কিছু মানুষের মাথায় সেগুলো গেঁথে যায়। পরবর্তী সময়ে ওই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে বাচাল লোকটির কথাগুলো স্ক্যানিং করেন। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে উদ্যোগী হন। তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে এটাও কি কম পাওয়া?
মজার ব্যাপার হলো, আমরা বিরক্তিকর পণ্যগুলোও খুব মনোযোগ সহকারে স্ক্যান করি। দেখবেন যে ছেলেটার পোশাক-আশাক, চুলের কাটিং, বডি ল্যাংগুয়েজ কোনো কিছুই আপনার ভালো লাগে না, তাকেও কিন্তু আপনি আড়চোখে ভালোভাবেই দেখেন! কারণ সমালোচনার জন্য হলেও তো তার সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানা ও বিশ্লেষণ করা দরকার। আমরা দৈনন্দিন জীবনে এমন অসংখ্য তথ্য প্রতিনিয়ত স্ক্যান করি।
বিস্ময়করভাবে টেলিভিশন বা অন্যান্য মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলো তাদের অন্যতম। কারণ আজকাল কানেকটেড থাকার স্বার্থেই আমাদের অনেক কিছু জানতে হয়। তা আমার জীবনে সরাসরি কাজে না লাগলেও। যেমন ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য জানি। কিন্তু সেগুলো কি কখনো কেনার কথা ভেবে তা সম্পর্কে পড়ি বা নিউজ দেখি?
অবশ্যই না।
এমনকি লোকে ভাবে টেলিভিশনে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয়? মানুষ ওসব দেখেও না শুনেও না; অযথা পয়সা নষ্ট। সত্যিই কি তাই? কোম্পানির কর্তারা এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে কম বোঝেন নাকি বেশি? দেশে-বিদেশে এ বিষয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন, গবেষকদের সাহায্য নিচ্ছেন, আউটপুট নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। তার পরও তারা সেটা কনটিনিউ করছেন। তার মানে বিজ্ঞাপনে কাজ হয়।
কী বিশ্বাস হচ্ছে না? রাত ১২টার পর বিভিন্ন স্কাইশপের যে বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার হয়, আপনার চেনা জানা কেউ ওসব পণ্য কেনে? আমি আজ পর্যন্ত কাউকে পাইনি। তার পরও তারা বছরের পর বছর এত টাকা খরচ করে সেগুলো চালু রেখেছে কেন? কিছু মানুষ অবশ্যই সেগুলো কেনে। আর যখন দেখে তখন হয়তো কেনার কথা ভাবে না। কিন্তু যখন ওই সমস্যাগুলো অনুভূত হয় তখন সেটা অন্তত একবার ট্রাই করার ভাবনা মাথায় আসে। একজন প্রতারিত হওয়ার পরে হয়তো সেটা ফেলে দেয়। কিন্তু টেস্ট করার মতো আরো অসংখ্য মানুষ ঠিকই জুটে যায়।
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ’ বইয়ের লেখক। সূত্র: বণিকবার্তা, ০৮ নভেম্বর ২০২২।
শেয়ার করুন