সময়, অসময় ও দুঃসময়!- ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

খুব সম্ভবত ১৯৯৮ সালের কথা। সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর টিভিরুমে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। কারণ সেদিন ‘টাইটানিক’ মুভিটি প্রথমবারের মতো কোনো এক টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। সিনেমা শেষ হওয়ার পরও তার রেশ ছিল দীর্ঘক্ষণ।

পরে আড্ডায় এক বন্ধু জানতে চাইল—সিনেমার কোন বিষয়টি আমার কাছে অনবদ্য ঠেকেছে? জবাবে বলেছিলাম, এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডিকে এত রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা সত্যিই অতুলনীয়। শত শত মানুষের করুণ মৃত্যুর দৃশ্যকে ছাপিয়ে এক যুগলের অকস্মাৎ ভালোবাসাই দর্শক-হূদয়কে অনেক বেশি উদ্বেলিত করেছে!

অবশ্য সেই আড্ডায় উপস্থিত অধিকাংশের মতে সেলিন ডিয়নের গাওয়া ‘মাই হার্ট উইল গো অন’ শিরোনামের থিম সংটিই ছিল ওই সিনেমার প্রাণ। শুধু সেই গানের জন্যই মুভিটি বহুবার দেখা যায়। এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ কম। কারণ গত আড়াই দশকে ওই গানের আবেদন এতটুকুও কমেনি। বরং প্রতিবার শোনার সময় শরীরে এক ধরনের শিহরণ অনুভূত হয়। বলতে পারেন, এসব তো জানা কথা। এগুলো আবার এত ঘটা করে বলার কী আছে?

হ্যাঁ, বলার কিছু ছিল না। তবে সেদিন সেলিন ডিয়নের এক ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। লাইভে এসে জানালেন, সম্প্রতি তিনি এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সে রোগে তার সবচেয়ে দামি সম্পদটি হারাতে বসেছেন। অর্থাৎ অসুখের প্রভাবে তিনি আর গান গাইতে পারবেন না। এমনকি রোগের প্রকোপ এভাবে বাড়তে থাকলে হয়তো একসময় আর বাকযন্ত্র ব্যবহার করে স্বাভাবিক কথাও বলতে পারবেন না!

বিষয়টা ভাবা যায়? যার লাইভ কনসার্টে লাখ লাখ মানুষ কণ্ঠ মেলায়, পারফরম্যান্স চলাকালে তারা হয়ে পড়ে সম্মোহিত। তার ইউটিউব ভিডিওগুলোয় সহজেই মিলিয়ন ভিউ হয়। অথচ সে মানুষটা আর কখনো গান করতে পারবে না!

তাছাড়া দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে তার স্বামী প্রয়াত হয়েছেন ক’বছর আগে, সদ্য হারিয়েছেন তার ভাইকে। সাধারণ একজন মানুষের কাছে ওই রোগ শুধুই শারীরিক অসুস্থতা। কিন্তু তার ক্ষেত্রে শরীরের চেয়ে মনের ওপর এর প্রভাব অনেক বেশি হওয়ার কথা, তাই না?

গোটা দুনিয়া তাকে যে সম্পদের জন্য চেনে, আয়ের একমাত্র উৎস, সেটা আকস্মিক অকেজো হয়ে গেল! আগামী দুই বছর যত ট্যুর এবং কনসার্টের সিডিউল ছিল তিনি সেগুলো বাতিল করলেন। সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন।

দৃশ্যটা দেখার সময় ভাবছিলাম, তাকে সুস্থ করতে যদি এক মিলিয়ন ডলারের দরকার হয় তা একদিনে জোগাড় করা সম্ভব। এমনকি এক বিলিয়ন ডলার দরকার হলেও তা সংগ্রহ করা অসম্ভব নয়। তার পরও চিকিৎসকেরা খুব একটা আশার আলো দেখাতে পারছেন না! এখান থেকে কিছু কী শেখা যায়?

এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। দুনিয়ার অসংখ্য ব্যক্তি সফলতার শীর্ষে দাঁড়িয়ে আকস্মিক থামতে বাধ্য হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বঞ্চিত হয়েছে তাদের মহান সৃষ্টিকর্ম থেকে।

এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মনে পড়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অজ্ঞাত এক রোগে তার কলম থেমে যায়। তখনকার প্রেক্ষাপটে সেভাবে চিকিৎসাও করা সম্ভব হয়নি। ফলে আরো ৩৪ বছর বেঁচে থাকলেও তিনি কিছুই লিখতে পারেননি। পরিণত বয়সে যখন তার সেরাটি দেয়ার কথা তখন তিনি হয়ে গেলেন নির্বাক ও স্মৃতিভ্রম!

ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ বিজনেস আইকন স্টিভ জবস। এমনকি মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরও অ্যাপলের অন্যতম এ প্রতিষ্ঠাতা নানা প্রসঙ্গে উদ্ধৃত হন। প্রচলিত রীতি-নীতির বাইরে গিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেয়া ও সফল হওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

কখনো ব্যর্থ হলে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বল্পতম সময়ে ঘুরে দাঁড়াতেন। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টে পরাজয় তাকে বড় বিজয়ের উপলক্ষ এনে দিত। সেই মানুষটা সফলতার শীর্ষে দাঁড়িয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন।

তার সর্বোত্তম চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকট কখনোই হয়নি। দুনিয়ার সেরা ডাক্তাররা তার চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন। তার পরও মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তাকে চলে যেতে হয়!

অন্যদিকে বলিউডে আমার প্রিয় অভিনেতাদের একজন ছিলেন ইরফান খান। ক্যারিয়ারের চূড়ায় অবস্থান করছিলেন। কাজের চাপে দম ফেলার সময় ছিল না। তখনি হঠাৎ ধরা পড়ে প্রাণঘাতী রোগ। খবরটি তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন এভাবে:

‘প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান ট্রেনে চলছিলাম। হঠাৎ একজন কাঁধে হাত রেখে বলল: তোমার গন্তব্যে চলে এসেছ, এবার নামার পালা। আমি বললাম: না, আমি তো আরো অনেক পথ চলতে চাই, অনেক কিছু দেখতে চাই…। কিন্তু সে কিছুই শুনতে চায় না; আমাকে বুঝি এবার নামতেই হবে!’

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনিও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কি জানি কখন কোথায় কীভাবে আমাদেরও থামতে হবে? আমরা যতই এ ব্যাপারে সচেতন হই বা প্রস্তুতি নেই তা কি কোনো নিশ্চয়তা দেয়? না, দেয় না। তার বড় প্রমাণ হলো—বিনোদন জগতে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈর্ষণীয় সাফল্য পাওয়া তারকা মাইকেল জ্যাকসন।

কথিত আছে, ক্যারিয়ারে আশাতীত সফলতা পাওয়ার পর তিনি দীর্ঘায়ু পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। টার্গেট ঠিক করেন ১৫০ বছর বাঁচার। সে লক্ষ্যে তিনি ১২ জন ডাক্তার নিয়োগ করেন। তারা প্রতিদিন তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত পরীক্ষা করতেন। খাবার পরিবেশন করার আগে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হতো। খাটে লাগানো ছিল অক্সিজেন লেভেল ঠিক রাখার স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। শরীরের কোনো অঙ্গ পরিবর্তনের প্রয়োজনে বেশ ক’জন ডোনার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা ছিল।

তার ফল কী হয়েছে? সফলতার শীর্ষে দাঁড়িয়ে মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন! আবার হলিউডে অতি স্বল্পসময়ের ক্যারিয়ারে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিলেন মেরিলিন মনরো। অথচ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন!

আমাদের সময়ের হার্টথ্রব নায়ক সালমান শাহকে আমরা হারাই মাত্র ২৫ বছর বয়সে! যদিও তার মৃত্যুরহস্য আজো সন্তোষজনকভাবে উন্মোচিত হয়নি। তবু তিনি আমাদের মাঝে নেই— এটাই বাস্তবতা।

যা হোক, এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে, কিন্তু উপসংহারে পৌঁছার জন্য বোধহয় উল্লিখিত ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। জীবনে সফল হওয়ার আশায় আমরা নিরন্তর ছুটছি। সে লক্ষ্যে দিন-রাত একাকার করে ফেলছি। অনেক সময় সাধ্যাতীত ঝুঁকি নিচ্ছি, পেরেশান হচ্ছি। কিন্তু তা মাত্রা অতিক্রম করছে না তো?

প্রত্যাশিত সফলতায় অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়া কিংবা ব্যর্থতায় ভেঙে পড়া কোনোটাই ঠিক নয়। কারণ আমাদের জীবন সবসময় একই ধারায় ও গতিতে চলবে না। উত্থান ও পতন জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো কারণে বর্তমানকে ‘অসময়’ মনে হলে তা মেনে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। এমনকি দুঃসময় এলেও ভেঙে পড়া যাবে না। কারণ তা কোনো সমাধান দেয় না।

পাশাপাশি আমরা অনেকেই এক ভ্রান্ত ধারণা লালন করি। সফল মানুষের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়। সেটা হলো তার অনুপস্থিতিতে কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলবে না। সবাই তার সাজানো বাগান ধ্বংস করে ফেলবে। এমনটা ভেবে সাধ্যের বেশি চাপ নেন। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনায় আমরা কি সত্যিই অপরিহার্য?

আপনার পূর্বপুরুষ, যে বসের অধীনে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, আপনার ইন্ডাস্ট্রির আজ থেকে ৩০ বছর আগের আইকন ব্যক্তিটি আজো কি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন?

না, তাহলে আপনাকেও বিশেষ পরিস্থিতিতে হার মেনে নিতে হবে। সময় যদি নিষ্ঠুর রূপে আপনার সামনে হাজির হয় ধৈর্য ও দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করতে হবে।

তাছাড়া দুনিয়ায় অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, পদ-পদবি কোনো কিছুই আপনার হ্যাপি এন্ডিংয়ের নিশ্চয়তা দেয় না। অনেকে ভাবেন বৈধ-অবৈধ নানা পন্থায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করতে পারলেই জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা করা যাবে।

কথা সত্য, চিকিৎসা করা যাবে। কিন্তু মাউন্ট এলিজাবেথ কিংবা বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরবেন নাকি লাশ হয়ে—তার নিশ্চয়তা কী? নিশ্চয়ই সেলিন ডিয়ন, স্টিভ জবস বা মাইকেল জ্যাকসনের চেয়ে বেশি অর্থের মালিক আপনি হবেন না।

সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত মেধা ও যোগ্যতার সদ্ব্যবহারে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু সাফল্যের জন্য ‘ক্রেজি’ হওয়া যাবে না। কারণ তা আপনার বর্তমান সুখ কেড়ে নেবে। এরই মধ্যে অর্জিত সাফল্য ও সম্পদের ভ্যালু দ্রুত হ্রাস পাবে। রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে বাস করেও নিজেকে ভিখারি মনে হবে। এর চেয়ে বড় দৈন্য আর কী হতে পারে?

আপনি চিরদিন সফলতার শীর্ষে থাকবেন না। অন্যেরা আপনার স্থান দখল করবে—সেটা মানতে হবে। কিংবদন্তি বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমারের (মুহাম্মদ ইউসুফ খান) মৃত্যুর আগের কিছুদিনের ভিডিও দেখবেন।

অথবা লতা মঙ্গেশকর মারা যাওয়ার ক’দিন আগে হাসপাতালের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সেটা। দেখবেন সময় কীভাবে মানুষকে বদলে দেয়। তাই আপনারও উচিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা। না হলে অযথা মনঃকষ্ট বাড়বে, ফলে কোনো পার্থক্য হবে না।

ফলাফল প্রসঙ্গে মনে পড়ল, গত সপ্তাহে স্কুলের বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। বহু অভিভাবক সন্তানের কোনো বিষয়ে মাত্র ১০ নম্বর কম পাওয়াকে মানতে পারেননি। বাসায় বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। অথচ সে শিক্ষার্থী যে ওই বিষয়ে ৯০ নম্বর অর্জন করেছে সেটা তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। পজিশনের সামান্য হেরফের হওয়ায় তারা সমাজে ‘মুখ’ দেখাতে পারছেন না!

অথচ একবার ভাবুন আজ আপনার সে সন্তানের বয়সী কত শিশু হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে হয়তো জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। তাদের মা-বাবা কিন্তু ‘গোল্ডেন এ-প্লাস’ চাচ্ছে না। একশতে একশ পাওয়ানোর কথা কল্পনাও করছে না।

বরং তাদের সন্তানটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই খোদার কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া জানাবে। তাহলে আপনার সন্তান সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকার পরও কেন কৃতজ্ঞ হতে পারছেন না?

প্রিয় পাঠক, আসুন জীবনে অসময় বা দুঃসময় আসার আগে আমরা বতর্মান সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করি। এখন যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে শিখি। মানসিক তৃপ্তি বা স্বস্তির জন্য তার বিকল্প নেই। সেটা একবার রপ্ত করতে পারলে অতি সামান্য অর্জনেও জীবন হবে আনন্দময়।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১০ জানুয়ারি ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *