স্টাফ রিপোর্টার : বৃষ্টিপাত কমায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে, পানি হ্রাসের গতি ধীর হওয়ায় বন্যার্তদের দুর্ভোগ দীর্ঘ হচ্ছে।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পানিবন্দি মানুষের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগ বালাই। বানভাসি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বিশেষ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক। বন্যা দুর্গত এলাকার লোকজন প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে এদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবো সিলেটের তথ্য অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর মধ্যে কানাইঘাটে সুরমা বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার, আমলসীদে কুশিয়ারা বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা ২৮ সেন্টিমিটার এবং ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা ১০১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
কোম্পানীগঞ্জ : কোম্পানীগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কোম্পানীগঞ্জে ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় পুরো উপজেলা। এতে করে উপজেলার টিউবওয়েল ও নলকূপগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় তলিয়ে যাওয়া টিউবওয়েলের পানি ও বন্যার পানি পান করায় বাড়ছে পানি বাহিত রোগীর সংখ্যা। গতকাল শুক্রবার পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আরো ২৯ জন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ১৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। আগেরদিন বৃহস্পতিবার চিকিৎসা নিয়েছেন আরো ৩৫ জন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং বলেন, বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্গতদের সহায়তায় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
জকিগঞ্জ ঃ জকিগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, পানি ধীর গতিতে নামায় বন্যার্তদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের সাথে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জন জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল আহাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দক্ষিণ সুরমা ঃ দক্ষিণ সুরমা প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানি কিছুটা কমলেও ঘরে ও রাস্তায় এখনো পানি রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও দুর্গম স্থানে বসবাসকারী পানিবন্দী মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না। বন্যায় সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের মল্লিকপুর নামক স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় যনবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করছে।
সুনামগঞ্জ ঃ সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জানান, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুনামগঞ্জের সুরমা নদী বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে, বন্যার পানি পুরোপুরি না কমায় এখনও অনেকের ঘরবাড়ি থেকে পানি নামেনি। ফলে আশ্রয় কেন্দ্রে এখনও মানুষ রয়েছেন। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. আহমদ হোসেন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার ১১টি উপজেলায় পানিবাহিত রোগে ১০৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
দোয়ারাবাজারঃ দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে দ্বিতীয় দফা ভয়াবহ বন্যার রেশ না কাটতেই তৃতীয় দফা বন্যার সূচনা। ইতিমধ্যে উপরিভাগ থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়া বিভিন্ন এলাকা আবারো প্লাবিত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন উপজেলাবাসী। সাম্প্রতিক সর্বনাশা ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত ব্রিজ-কালভার্ট আর ভাঙন কবলিত বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়কের পানি নামতে থাকায় জরুরি কাজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জলস্থল ডিঙিয়ে চলাচল শুরু করছিলেন সকল পেশার লোকজন। উপজেলা ও জেলা সদরের সাথে আবারো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। বিনিদ্র রাতদিন আতঙ্কে কাটছে সুরমা, বগুলা, মান্নারগাঁও ও দোয়ারা সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বানভাসি লাখো মানুষের। কেননা দ্বিতীয় দফা আগ্রাসী বন্যার পানি এখনো নামেনি নিম্নাঞ্চল থেকে। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সর্বস্ব হারানোর ভয়ে বিপাকে পড়েছেন গবাদি পশু ও মৎস্য খামারীসহ কৃষিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা। অপরদিকে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো মোটামুটি চলতে পারলেও কঠিন বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সমাজে আত্মসম্মান রক্ষার্থে চক্ষুলজ্জায় সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে পারেননি তারা। নিরবে সইছেন সব ব্যথা-বেদনা। পরিবার-পরিজন নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে কালযাপন করছেন তারা। এদিকে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বিকালে এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় পানি বাড়ছে না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা প্রিয়াংকা, বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান তানভীর আল আশরাফী চৌধুরী বাবু, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক, ওসি দেবদুলাল ধরসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রতিদিন উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় বানভাসিদের মধ্যে বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করেন তারা।
মৌলভীবাজারঃ মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে দিন অতিবাহিত করছেন। জেলার হাওর তীরবর্তী এলাকার ৭০/৮০ শতাংশ ঘরে এখনও পানি। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে আবার, কেউ কেউ ঘরে পানির মধ্যে দিনাদি করছেন। কিছু পরিবার উজান এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে, দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মানুষের মধ্যে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। শুকনো জায়গা না থাকায় পানিতে হাঁটায় অধিকাংশ মানুষের পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বন্যার্ত মানুষ হাসপাতালে যেতে পারছেন না। সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় ৪৯ জন, চর্ম ৫০জন, জ্বরে ১৪ জন, চোখের ভাইরাস ১২ জন, চোখে আঘাতপ্রাপ্ত ৬ জন, সাপে কাটা ৪ জন, অন্যান্য রোগে ৩৭ জনসহ মোট ১৭২ জন শিশু, নারী ও পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে, গত ৮দিনে জেলায় পানি বাহিত বিভিন্ন রোগে মোট ৭৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
উপজেলার প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষের সঙ্গে গবাদিপশু পাশাপাশি অবস্থান করছেন। কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় পুরো নিচ তলায় গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। চলমান বন্যায় মৌলভীবাজারে মৌসুমি গরুর খামারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। অনেক খামারীরা গরু নিয়ে চরম বিপাকেও পড়েছেন। খাদ্য সংকটের কারণে কমছে গরুর ওজন। এবার লাভের চেয়ে লোকশানের চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। পানি বাড়ায় কোনো কোনা এলাকায় চুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারীরা রাত জেগে গরু পাহারা দিচ্ছেন। সরেজমিন দেখা যায়, জেলার হাওর পারের এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় খামারীরা বাজার, ব্রীজ ও রাস্তার পাশে গরু রাখছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৭ উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের ২০ হাজার ৯’শ ৯টি গরু, ১ হাজার ৭’শ ৭০টি মহিষ, ৭ হাজার ৪’শ ১৫টি ছাগল ও ১ হাজার ৫’শ ৩৩টি ভেড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারীদের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৬ লক্ষ ১২ হাজার ৩’শ টাকা। আসন্ন কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে মৌলভীবাজার জেলায় কোরবানী যোগ্য গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে গরু ৪৩ হাজার ৪’শ ৯৪টি, মহিষ ২ হাজার ৮’শ ১৬টি, ছাগল ১২ হাজার ৬’শ ২১টি ও ভেড়া ৫ হাজার ২৬টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নিম্নবিত্তরা ত্রাণ সামগ্রী পেলেও অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাবে থাকার পরেও কারো কাছে হাত পাততে পারছেন না। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষ। নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাওর তীরের বাসিন্দারা।
সরেজমিন কুলাউড়া উপজেলার ভুকমিশইল ইউনিয়নে গেলে দেখা যায়, ইউনিয়নে যাতায়াতের প্রতিটি রাস্তা এখন পানির নিচে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দির তলিয়ে গেছে। প্রতিটি হাটবাজার এখনও পানির নিচে। মানুষের চলাচলের কোনো জায়গা নেই। এসময় জাব্দা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ রিয়াজুর রহমান বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এই অঞ্চলের মানুষ। কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা ময়নুল ইসলাম সোহাগ বলেন, পানি না কমলে মানুষের দুর্ভোগে অন্ত থাকবে না।