হাওর–অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার তথ্য এটি। মার্চ থেকে মে—এ তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এ সময় হাওরে বোরো ধান তোলায় ব্যস্ত থাকেন কৃষকেরা। আবার বর্ষায় মাছ ধরতে হাওরে দিনরাত কাটে জেলেদের। তখন বজ্রপাতে প্রচুর প্রাণহানিও ঘটে। এ ছাড়া ঝড় ও ঢেউয়ে ঘটে নৌকাডুবি। এতেও প্রাণ যায় অনেকের। দুর্গম হাওরে মাইলের পর মাইল কোনো স্থাপনা নেই। বজ্রপাত, ঝড় ও ঢেউয়ের কবলে পড়া জেলে-কৃষক, নৌকার যাত্রীদের নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই।
বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয়, কাজের সময় বিশ্রামের বিষয়টি চিন্তা করে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে কৃষক ও জেলেদের জন্য ‘লাইটনিং শেড’ (আশ্রয়স্থল) নির্মাণ করা হচ্ছে। পাকা এই স্থাপনা অনেকটা টাওয়ারের মতো। স্থানীয় লোকজন বলছেন, উদ্যোগটি খুব ভালো। এতে তাঁরা উপকৃত হচ্ছেন। সব হাওরেই এ রকম আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা দরকার।
সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ এসব আশ্রয়কেন্দ্র বা আশ্রয়স্থল নির্মাণ করছে। এ তিন উপজেলায় ২১টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এখন পর্যন্ত চারটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। একেকটিতে ব্যয় হবে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলার শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের খোয়ার হাওরে একটি আশ্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন এটির উদ্বোধন করেন। এ সময় শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু তালেব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও হাওরপারের বাসিন্দারা উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্রটির উচ্চতা ১৮ ফুট। মাঝখানে ৯ ফুট পাকা মেঝে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় সেখানে। এই মেঝের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২ ফুট করে। চারপাশে তিন ফুট দেয়াল আছে। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির জন্য একটি নলকূপ। মূল ছাদের ওপর রয়েছে বজ্রনিরোধক দণ্ড ও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। রাতে হাওরে চলাচলকারীদের জন্য একটি লাল বাতির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এসব বাতি অনেক সময় মানুষের পথনির্দেশকের মতো কাজ করবে।
যে স্থানে এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেটির আশপাশে কোনো বাড়িঘর, অন্য কোনো স্থাপনা ও গাছগাছালি নেই। জেলে-কৃষকেরা সমস্যায় পড়লে আশ্রয় নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। খোয়ার হাওরপারের আটগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আবদুল ছায়াদ (৬০) বলেন, গ্রাম থেকে হাওরের মাঝখানে যেতে শুকনা মৌসুমে হেঁটে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। তখন ঝড়বৃষ্টি কিংবা বজ্রপাত হলে হাওরে থাকা মানুষদের মাথার ওপর কোনো ছাদ থাকে না। অনেকে কাজ ফেলে বাড়িতেও আসতে চান না। এসব আশ্রয়কেন্দ্র বড় উপকারে লাগে তখন। শুধু বিপদের সময় নয়, হাওরে কাজের সময় অনেকে এখানে এসে বিশ্রাম নেন। পানির ব্যবস্থা বেশ ভালো হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
নিজগাঁও গ্রামের জেলে আহমদ মিয়া (৩৫) বলেন, ‘বাইরাত (বর্ষায়) মাছ ধরায় থাকলে ঝড়-তুফান অয়। তখন যাওয়ার জায়গা থাকে না। অখন ইটায় (আশ্রয়কেন্দ্র) ভরসা অইছে।’ কৃষক আবদুল আহাব (৪১) বলেন, ‘বৈশাখ মাসও ঠাঠা (বজ্রপাত) অয় বেশি। বিপদের সময় দৌড়াইয়া যাওয়ার জায়গা নাই। এখন তো যাওয়ার একটা জায়গা অইল। গরমও একটু জিরানো যাইব।’
আটগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, হাওর তো অনেক বড়। একাধিক স্থানে এসব আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারলে বেশি মানুষ উপকার পাবেন।
প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী নুরুল ইসলাম সরকার জানান, জেলার শাল্লা উপজেলায় তিনটি এবং দিরাই উপজেলায় একটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। অন্যগুলোর কাজ আগামী শুকনো মৌসুমে শেষ হবে। শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওর, খোয়ার হাওর, গিলাটিয়া হাওর, ধোপাজোড়া হাওর, দীঘলবন্দ হাওর, ইরাউরা হাওর; দিরাই উপজেলার কালিয়াকোটা, বরাম, ঘাগুটিয়া, উদগল, চাপতি টাঙ্গুয়া; তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, কোপাউরা ও মাটিয়ান হাওরে এসব আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
শাল্লার ইউএনও মো. আবু তালেব বলেন, শুকনা মৌসুমে ধান রোপণ, ধান তোলার সময়ে কৃষকেরা এসব আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করছেন। আবার বর্ষায় জেলেরা হাওরে যখন মাছ ধরেন, তখন যেকোনো বিপদে সেখানে আশ্রয় নিতে পারছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘হাওরে কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিপদের সময় জেলে-কৃষকেরা একটু নিরাপদ জায়গায় যে যাবেন, তার সুযোগ থাকে না। দৌড়ে দূরের গ্রামে যেতে হবে, ততক্ষণে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো করার উদ্দেশ্য হলো, যাতে তাঁরা বিপদের সময় দ্রুত একটা নিরাপদ জায়গা পান। পাশাপাশি এসব তাঁদের জন্য একটা ভালো বিশ্রামের জায়গাও হলো।’
শেয়ার করুন