বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে

জাতীয়

ফারাক্কা বাঁধকে বাংলাদেশের মরণফাঁদ বলা হলেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে। এ কারণে রাজ্য দুটি ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশ কয়েকটি চিঠিও দিয়েছে।

একই কথা বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের তিস্তা এবং ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের ক্ষেত্রেও। ভারতীয় অ্যাক্টিভিস্টদের দাবি, এভাবে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদী সরে যাচ্ছে এবং বিপুল এলাকায় দেখা দিচ্ছে খরা ও বন্যা।

ভারতের বিখ্যাত অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকার সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। দেশটির জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।’

ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর বাঁধ নিয়ে নয়াদিল্লির কাছে প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গের

গঙ্গা ও তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ যে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি, সেটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখে জানিয়েছেন দিল্লিকে। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লেখেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

চিঠিতে ফারাক্কা প্রসঙ্গে মমতা লিখেছেন, প্রথমত গঙ্গা ক্রমেই আরও পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে সুন্দরবনে পানি কম যাচ্ছে। এই বাঁধের ফলে উজান ও ভাটিতে প্রবল ভাঙন শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর সম্পত্তি, যার মধ্যে রয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো স্থাপনা-অবকাঠামো। এই ভাঙন রোধে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গকে যে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাও দেয়নি।

তিস্তা প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সিকিমে একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার পানি কমে গেছে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগ করা হলে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি রয়েছে।

বিহারের আপত্তি

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও প্রায় ১৫ বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করে আসছেন। বিশেষত ২০১৬ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার বিহারে বড় বন্যার কারণ হিসেবে ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেন তিনি। নীতিশ কুমারও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন।

গঙ্গা থেকে বেরোনো বিহারের কোসি নদী নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করা গোপাল কৃষ্ণ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে উত্তর, পূর্ব ও মধ্য বিহারের অন্তত সাতটি জেলা ফারাক্কার এই বাঁধ ও অন্য বাঁধের কারণে বিপর্যস্ত। প্রতিবছরই হয় বন্যা হচ্ছে অথবা আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।’

সিকিম, আসাম ও ত্রিপুরায় বিরূপ প্রভাব

তিস্তা নদীর ওপর একাধিক বাঁধ নির্মাণের কারণে সিকিমে পাহাড়ধস, বন্যা ও খরা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের এই রাজ্যটিতে পাহাড়ধসে ভেঙে পড়েছে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের (এনএইচপিসি) একটি বাঁধ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ের বিশাল অংশ ধসে পড়ছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর। তাতে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে বাঁধের বড় একটি অংশ। গত কয়েক দিনে একাধিকবার ছোটখাটো ভূমিধসের কারণে আগেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর আগে গত বছর মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভেঙে গিয়েছিল চুংথাংয়ে তৈরি আরেকটি বাঁধ। এখনো সেই বাঁধ পুরোপুরি ঠিক করা যায়নি।

ভারতের পরিবেশবিদ অরূপ গুহ জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলকে বলেন, এমন যে হবে, সে আশঙ্কা ছিলই। পাহাড়ে এবং ডুয়ার্সে তিস্তার ওপর একের পর এক প্রকল্প তৈরি হয়েছে। নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে। পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

সম্প্রতি একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকারও বলছেন, বাংলাদেশের মতো ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতেও বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।

বাঁধ নির্মাণবিষয়ক এক গবেষণায় সম্প্রতি বলা হয়, অবকাঠামো হিসেবে বাঁধ কেবল নদীপ্রবাহেরই সর্বনাশ করছে না, ভূমিকম্পপ্রবণ আসাম-বাংলা ভাটি অঞ্চলকে চিরস্থায়ী এক বিপদের মুখেও রেখে দিয়েছে। এ ছাড়া এ রকম অবকাঠামোর নীরব প্রতিক্রিয়া হিসেবে নদী অববাহিকার নানা স্থানে নিরন্তর ভাঙন চলছে।

বাংলাদেশের প্রতিবাদ

১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা নামক জায়গায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করে ভারত। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নানা আলোচনার আড়ালে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। কিন্তু ভারতের প্রতিশ্রুত পানি বাংলাদেশ কখনোই পায়নি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘেও সোচ্চার ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনোই পানি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর ২০০৯ সালে এটি নির্মিত হয়। এই বাঁধ টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক ও তুইভাই নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। অভিন্ন নদীর উজানে এই বাঁধ ভাটির বাংলাদেশের পরিবেশ আর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও ভারত কর্ণপাত করেনি।

সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। উজানের পানি ত্রিপুরার বিভিন্ন জনপদ ভাসিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাংলাদেশে। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে বানের পানি ঢুকতে থাকায় ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে।

বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়টি ত্রিপুরার গোমতী জেলা প্রশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে নিশ্চিত করেছেন। এক্সে তিনি লিখেছেন, গোমতী নদীতে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার ফলে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তরও বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছে।’

যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি দাবি করেছে যে বাংলাদেশের বন্যা ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে হয়নি। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক নদী আইনের নীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষতি করা যাবে না। উজানের দেশ যারা তাদের ভাটির দেশকে জানানোর কথা- যখন এ রকম অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়, পানি ছাড়ার দরকার হয়। একটু জানিয়ে দিলে প্রস্তুতি রাখা যায়। মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়া যায়। সেটি এবার প্রতিপালিত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন সময় এসেছে এই ব্যাপারে বাঁধগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ার। অভিন্ন নদীতে ভারত যেসব বাঁধ দিয়েছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। কেননা অভিন্ন নদীতে কোনো একটি দেশের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *