বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি : বিষয় বাছাইয়ে বিবেচ্য-ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় বিষয় পছন্দ একজন শিক্ষার্থীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় অনেক সময় না বুঝে, আবেগে, অনভিজ্ঞ লোকের পরামর্শে। ফলে সারাটা জীবন তাদের ভুগতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় মা-বাবা যাদের মতামত অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তাদের চাপিয়ে দেয়া নির্দেশনার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি কেউ কেউ পড়ালেখা শেষ করতে পারে না! তাই একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় কোন বিষয় পছন্দ করবেন তা নির্ধারণে মৌলিক কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। এ নিবন্ধে সে দিকগুলোয় ফোকাস করতে চেষ্টা করব।

আমার এক আত্মীয় গত বছর ফোন করে জানালেন তার ছেলে ভর্তি পরীক্ষায় বেশ ভালো করেছে। অনেক বিষয় পড়ার সুযোগ আছে। এখন সে কোন বিষয়ে ভর্তি হলে ভালো হয়—এটা ছিল মূল জিজ্ঞাসা। আমি বিস্তারিত জেনে, শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে তাকে লোকপ্রশাসন বা সমাজকর্ম বিষয়ে পড়ার পরামর্শ দিলাম। কিন্তু তার বাবা আবার ফোন করে নানা বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বুঝলাম তিনি অন্য কিছু চাচ্ছেন। তখন তাকে খোলাখুলি নিজের মতামত জানাতে বললাম। তিনি বললেন, ইংরেজি বা অর্থনীতিতে অনার্স পড়লে ভালো হতো না?

আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না। কারণ তিনি যখন কলেজে পড়েছেন তখন শুনেছেন এ বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রায় তিন দশক পরে এসেও তিনি সেটা অর্জনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন। অথচ শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ারসংক্রান্ত প্রত্যাশা, তার ভালো লাগা, দক্ষতা এর কোনোটাকেই তিনি বিবেচনায় নিচ্ছেন না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কখনই শিক্ষার্থীর চাওয়া-ভালো লাগাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। মেডিকেলে পড়ার জন্য নিবেদিতপ্রাণ অসংখ্য শিক্ষার্থী এখন বিবিএ পড়ছেন। কম্পিউটারের বেসিক বিষয়গুলো জানেন না এমন শিক্ষার্থীরা অবলীলায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হচ্ছেন। কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না নিয়েই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। যার শিল্প-সাহিত্য ভালো লাগে তিনি জীবনের স্বর্ণসময়ে মুখ গুঁজে অ্যাকাউন্টিং বা ফাইন্যান্স চর্চা করছেন। এমনটা হওয়ার কারণ মা-বাবার প্রত্যাশা, পরামর্শদাতাদের অগভীর দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা প্রচলিত কিছু হাইপ (গুজব)। তাই উচ্চতর পড়াশোনায় বিষয় পছন্দের ক্ষেত্রে আরো বাস্তববাদী ও যুক্তিশীল হওয়া জরুরি।

প্রথমে বুঝতে হবে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে একজন শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পড়ালেখা করেন তা দ্বারা মোটামুটি সারাজীবন প্রভাবিত হন। তাই চাকরির বাজারে চাহিদা আছে, সমাজ খুব ভ্যালু দেয় কিংবা মেধাবী ছাত্ররা ওই বিষয় পড়ে… এমন ট্যাবুর ওপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষার্থীকে সেদিকে ঠেলে দেয়া ঠিক নয়।

দ্বিতীয়ত, মা-বাবার ছাত্রজীবনে যেসব বিষয় ‘ভালো’ বলে গণ্য হতো আজও সেটা ভালো বলে গৃহীত হচ্ছে কিনা তা খোঁজ নেয়া দরকার। অতীত বা বর্তমানের তথাকথিত ভালো সাবজেক্ট নয় বরং ভবিষ্যতে (আরো ৫-১০ বছর পরে) কোন বিষয়ের চাহিদা হবে তা বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।

তৃতীয়ত, আজকাল অনেকেই মনে করেন যেনতেন বিষয়ে ভর্তি হয়ে একটা ডিগ্রি নেবেন। আর সত্যিকারের পড়াশোনা করবেন বিসিএসের জন্য। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা শুনতে মধুর হলেও তা ভালো ও কার্যকর পন্থা নয়।

পরিশেষে বলব, আমাদের দেশে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শুধু চাকরির বাজার বিবেচনায় নেয়া হয়। এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সময়ে বিদেশে পড়াশোনার দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত। শুধু এ মাসে আমার সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, জুনিয়র মিলে প্রায় ১০ জন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ভিসা ইস্যু করার জন্য মার্কিন দূতাবাস শুক্রবারেও অফিস খোলা রেখেছে!

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর পড়তে যাচ্ছেন। বিষয়টা বিশেষভাবে বিবেচনা করা দরকার।

সর্বোপরি কথা হলো—আগামীতে কেউ আপনাকে চাকরি দেবে আর আপনি সেটা করবেন, এ পরিস্থিতি থাকবে না। তাছাড়া চাকরির স্থায়িত্ব খুব কম হবে। তাই দিন শেষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা নিজে একটা উদ্যোগ নিতেই হবে। তাই এমন বিষয় পছন্দ করুন যেন প্রচলিত দৌড়ে সফল না হলেও নিজে ‘একটা কিছু করা’র মতো সাহস ও দক্ষতা অর্জন হয়। যে বিষয়েই ভর্তি হন না কেন অন্যদের তুলনায় আপনি কত বেশি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলেন, সে বিষয়টা জরুরি। নইলে শুধু পছন্দের বিষয় আপনাকে প্রত্যাশিত কর্মজীবনে প্রবেশ বা টিকে থাকতে সাহায্য করতে পারবে না।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। বণিকবার্তা, ১ আগস্ট ২০২২।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *