আমার স্মৃতিতে এম.সাইফুর রহমান – মুনশী ইকবাল

মুক্তমত

 

এম.সাইফুর রহমান। একজন সিলেটপ্রেমী হিসেবে যার নাম অবিস্মরণীয়। তাকে আমরা আধুনিক সিলেটের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে চিনি। তার উন্নয়নযজ্ঞ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সিলেটের উন্নয়নের কথা মনে হলেই যে দুটি নাম শ্রদ্ধার সাথে মনের মাঝে ভেসে ওঠে তা হলো সাবেক অর্থমস্ত্রী এম. সাইফুর রহমান এবং সাবেক স্পীকার হুমায়ুর রশীদ চৌধুরী। তারা দুজনেই আজ দুনিয়ায় নেই। আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন।
ব্যক্তিগত ভাবে সিলেট আমার গর্ব এবং আবেগের জায়গা। এইজন্য আমি যখন সিলেটে বাইরের কারো সাথে কথা বলি তখন তাদের কেউ যদি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বুঝেন তাহলে আমি তার সাথে প্রমিত ভাষায় কথা বলিনা। তিনি তার ভাষায় বলেন, আমি আমার ভাষায় বলি, আমাদের কোনো সমস্যা হয়না। আমার এমন অভিজ্ঞতা আছে। একই চিত্র ইংরেজির বেলায়ও।

একজন আপোষহীন সিলেটি হিসেবে সাইফুর রহমানের প্রতি আমার ভালোলাগা সম্পূর্ণ আলাদা। আজ ৫ সেপ্টেম্বর তার চলে যাওয়ার দশ বছর হয়ে গেল। সিলেট আমার শহর, এই শহরের নাভীর মধ্যেই আমার জন্ম। তাই শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত সিলেট খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি। আমাদের শৈশবের অবহেলিত উন্নয়ন বঞ্চিত সিলেটকে তারুণ্যে আমি দেখিছি জাদুর মতো বদলে যেতে। যে এলাকাগুলো ছিল অসমাজিক কাজের অভয়ারণ্য সেই এলাকা সুন্দর করে বদলে দেওয়া হয়েছে। যে সুরমা নদীর তীরে সন্ধ্যের পর লোকজন যেতে ভয় পেতো সেই ক্বীন ব্রিজের নিচে সরমার তীরকে লন্ডনের টেমসের তীরের মতো বদলে দিয়ে দর্শনীয় জায়গার বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যের পর লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে আসে একটু শান্তির বাতাস নিতে। যেসকল এলাকা দিয়ে একসময় মানুষ তো দূরে থাক পশুরা পর্যন্ত চলাচল করতো না সেইসব এলাকায় দিয়ে হাওরের মাঝ দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল সড়ক-বাইপাস। ইট সলিং আর জোড়াতালি দিয়ে থাকা সিলেট শহরের রাস্তাগুলো একসময় এতটা উন্নত হয়েছিল যে আমরা যখন এইসব রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হতাম তখন মনে হতো সাইকেল যেনো অটো চলছে। বিশেষ করে সিলেট নগরীর বন্দর থেকে আম্বরখানা এবং চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার সড়কে উঠলে আমাদের মনে হতো সাইকেলে যেনো পাখা গজিয়েছে।

এইসব আমি দেখেছি আমার চোখের সামনে। আর এইসব কিছুর মূল কারিগর ছিলেন মরহুম এম.সাইফুর রহমান। এইজন্য আমি দলমত নির্বিশেষে আমার পরিচিত সবার কাছে দেখেছি সাইফুর রহমান এক ভালোবাসার নাম। সাইফুর রহমানের এই উন্নয়ন কাজের বেশকিছু পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল মরহুম স্পীকার হুমায়ুর রশীদ চৌধুরীর সময়কালে। স্পীকার যে কাজের সূত্রপাত করেছিলেন সাইফুর রহমানের দল ক্ষমতায় আসার পর তিনি তা অব্যহত রাখেন। এইজন্য শত রাজনীতিবিদদের ভিড়ে এই দুই রাজনীতিবিদকে সিলেটবাসি আজও মনে করেন শ্রদ্ধার সাথে।

সাইফুর রহমান উন্নয়ন কাজ করেই থেমে থাকেননি। তিনি তা ঠিকঠাক রক্ষনাবেক্ষণের জন্য সুযোগ পেলেই খোঁজ নিতেন। এইসব ব্যাপারে তার কতো যে টান তা একটা ঘটনায় বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি সরাসরি সেদিনের সাক্ষী ছিলেম। দিন তারিখ মনে নেই। সেই সময় ফজরের নামাজের পর আমি নিয়মিত হাঁটতে বেরুতাম। তখন সবে ক্বীন ব্রিজের তীর সুন্দর করা হয়েছে। আমাদের দাড়িয়াপাড়ার বাসা থেকে ক্বীন ব্রিজ আধা কিলোমিটারের মতো দূরে। আমি সাধারণত জল্লারপাড় থেকে জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা হয়ে পুরাতন মেডিকেল হয়ে বাসায় চলে আসতাম, কখনও একটু এগিয়ে রিকাবীবাজার থেকে লামাবাজার অব্দি এগিয়ে গিয়ে মির্জাজাঙ্গাল জামতলা হয়ে বাসায় আসতাম। একদিন কি মনে করে ক্বীন ব্রিজের ওদিকে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখলাম সাদা কালো ডোরাকাটা টি শার্ট, ট্রাউজার আর সাদা ক্যাডস পড়া, হাতে কালো রঙের লাঠি, একজন লোক একা একা এড়িয়ে আসছেন। দূর থেকে দেখে তাকে চেনা চেনা মনে হলো। এরমধ্যে তার আশপাশে কিছু সাধারণ লোক ভিড়েছেন। আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর তাকে চিনতে পাড়লাম, তিনি এম.সাইফুর রহমান। রাতে সুরমার তীরে সার্কিট হাউজে ছিলেন। ভোরের আলো একটু ভালো করে ফোটার সাথে সাথে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে গেছেন তার স্বপ্নের সুরমার তীর দেখতে, যে সুরমার তীরকে তিনি টেমসের মতো সাজাতে চেয়েছেন। আমিও সেই লোকজনদের সাথে মিশে গেলাম যারা তার পাশে ছিলেন। আমরা তার পাশে পাশে হাঁটছিলাম, তিনি আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন কতো টাকা খরচ করে এইসব কাজ করিয়েছি দেখো এগুলো খেয়াল কেউ করছেনা, এই দেখো ময়লা জমে আছে। এরমধ্যে সার্কিট হাউজে খবর হয়ে গেছে ‘স্যার নেই’, একা বেরিয়ে গেছেন কাউকে না বলে। সার্কিট হাউজের কর্তারা আর দায়িত্বরত পুলিশের লোকজন ছুটে এলেন। তিনি তাদের তার আক্ষেপের কথা বললেন। আমাদের সাথে তিনি যখন কথা বললেন মনে হলো আমরা যেনো তার কতো পরিচিত। সেই সময় সেলফি কিংবা ফেইসবুকের যুগ ছিল না। ছবি তোলা যায় এমন মোবাইলও সবার ছিলনা। ফলে সেসব দিনের কোনো ছবিও নেই।

এরপর তিনি আলী আমজাদের ঘড়ির নিচে একটা ভ্যানের কাছে গেলেন। বিক্রেতা এতে চিকর মাটি নামে এক ধরণের মাটি বিক্রি করছেন। নানান রোগবালাই আর উপকারের কথা চিন্তা করে সিলেটে অনেকেই এই মাটি খেতেন। অনেকটা মিমি চকলেটের মতো দেখতে চারকোনা টুকরো টুকরো করে এটা বিক্রি হতো। সাইফুর রহমান তখন মন্ত্রী। তিনি ঐ বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন এটা কী? তখন বিক্রেতা তাকে চিকর মাটির কথা বললে তিনি বললেন এইসব এখনও আছে নাকি আমরা তো সেই ছোটবেলা এই মাটি খেয়েছি, তিনি একটা টুকরো হাতে নিলেন। এর একটু পর তিনি চলে গেলেন, আমরাও কিছু সময় থেকে চলে এলাম।

সেদিন খুব বেশি লোকজন সেখানে ছিলেন না, অল্প কয়েকজন মাত্র। আমি আমার পাড়ার আরেকজনকে সেখানে পেয়েছিলাম। আমরা দুজন তখন কথা বলতে বলতে আসছিলাম। আমার পাশের জন ছিলেন সিলেটের একটি নামী জমিদার পরিবারের সন্তান, আমরা পারিবারিকভাবে বেশ ঘনিষ্ট ছিলাম। তার বড়ো ভাই আমার আব্বার বন্ধু ছিলেন, তাদের আমরা মামা ডাকতাম। তিনি একজন আওয়ামীলীগ নেতাও ছিলেন। তো সেই মামা আমাকে বললেন দেখো কতো ভালো মানুষ, কতো দরদ সিলেটের জন্য, কতো সহজ সরল। এই মানুষ আর সিলেটে আসবে না। আমি তার সাথে মিলিয়ে বললাম, আসলেই কতো সরল সাইফুর রহমান। এটাই ছিলো এম.সাইফুর রহমানের বরাবরের চিত্র। তিনি খুব জটিল ছিলেন না।

এ ব্যাপারে পরে আমই দৈনিক জালালাবাদ সম্পাদক, প্রখ্যাত সাংবাদিক নেতা মুকতাবিস উন নূর ভাইয়ের একটি বইয়ে একনজর তার সত্যতা পেয়েছিলাম।
নূর ভাই লিখেছেন, “একজন নিখাদ ‘সিলেটি’ ছিলেন এম.সাইফুর রহমান। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ১২বার বাজেট পেশকারী অর্থমন্ত্রী এম.সাইফুর রহমান ছিলেন একজন পেশাদার একাউন্টেন্ট। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার পরও রাজনীতির জটিল প্যাঁচ বুঝতেন না। রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। এরপরও সাইফুর রহমান ছিলেন একজন সরল রাজনীতিবিদ। মনে যা হতো, মুখে যা আসত সোজাসাপ্টা বলে দিতেন। ….
যাকে বিশ্বাস করতেন, অনেকটা অন্ধের মতো বাছবিচার ছাড়াই তার কথা শুনতেন। উন্নয়নের ব্যাপারে তাকে কিছু বুঝিয়ে দিতে পারলে সাথে সাথে তা শুরু করে দিতেন। প্রক্রিয়ার ধার ধারতেন না। স্থানকালপাত্র সব বুঝতেন না, শিশুর মতো সারল্য তার মধ্যে লক্ষ করা যেত। যে-কারণে তিনি অনেকের বিশেষ করে অনেক মন্ত্রী ও আমলার বিরাগভাজন ছিলেন। তার কর্মকান্ডের কারণে প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে পছন্দ করতেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাকে সমীহ করতেন। তার সোজাসাপ্টা কথার জন্য বিরোধী দলীয় নেতারাও তাকে সম্মান করতেন।”

আমার একনজরে দেখা সাইফুর রহমান এবং মুকতাবিস উন নূর ভাইয়ের এই লেখায় আমি আলাদা কোনো ব্যক্তিকে পাইনি। আমার চিন্তার সত্যতা আমি পেয়েছিলাম এই লেখায়। এটা অনেকটা গণিতের মতো। গণিত যেখানেই করা হোক, যেই করুক সঠিক হলে উত্তর সবার বেলায়ই এক হবে।

এম. সাইফুর রহমান এমন একটি নাম যে নাম শুনলে আমার ভেতর থেকে তার জন্য শ্রদ্ধা এবং মাগফিরাতের জন্য দোয়া চলে আসে। যিনি বেঁচে আছেন তার কাজে। এইজন্য রোজার মাসেও তার জানাজায় কড়া রোদে আমি ছুটে গিয়েছিলাম সিলেটের শাহী ঈদগাহে। তিনি ছিলেন একজন উন্নয়ন বান্ধব ব্যক্তি।
লেখক: সাংবাদিক, চিকিৎসক।
(০৫.৯.২০১৯)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *