ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখে নিবন্ধটি লিখছি। ২০২৩ সালের চলমান লাশের মতো এমন জটিল সময় বাঙালির জীবনে কোনোকালে আসেনি। সারা দেশে নির্বাচনের জোয়ার তোলার জন্য আওয়ামী লীগ যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে বহু মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এবারের নির্বাচন কেমন হবে তা বোঝার জন্য নির্বাচনী সুনাম-সুখ্যাতি, দুর্নাম-দুর্গতির কবলে পড়া নির্বাচন শব্দের হাল-হকিকত দেখলেই যে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন। অতীতের বিনা ভোট কিংবা রাতের ভোটের তকমা অর্জনের জন্য ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল এবং দিন শেষে একটি অবাক করা ফলাফল এবং উপাধি দেশবাসী দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এবারকার কাহিনী ভিন্ন। ভোটের বহু আগেই দেশবাসী জেনে গেছে, এবারের নির্বাচনটি হবে ডামি নির্বাচন। আর বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ হাসিনা।
উল্লিখিত ডামি নির্বাচনের প্রায় নিশ্চিত ফলাফল কি ডামি হবে, নাকি আরো অভিনব কিছু হবে তা কিন্তু এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচন-পরবর্তী যে সংসদ তৈরি করে সারা দুনিয়াকে চমক দেখানোর তোড়জোড় চলছে, সেখানে বিরোধী দল কারা হবে এবং বিরোধী দলের কোনো ডামি সংস্করণ থাকবে কি না তা নিয়ে আলোচনা শেষে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, প্রধানমন্ত্রী যাদের প্রতি দয়া করবেন এবং তার করুণা ও আশীর্বাদ যাদের ওপর আপতিত হবে তারাই কেবল বিরোধী দলরূপে সংসদের গদিতে বসার সুযোগ পাবেন এবং তাদের নেতাই হবে বিরোধীদলীয় নেতা, যাকে জনগণের টাকায় মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নানা রকম সুযোগ সুবিধাসংবলিত পদ-পদবি-পতাকার সমন্বয়ে সাজিয়ে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
ভোট নিয়ে এবার যা হচ্ছে তা যদি শেষমেশ সফল হয়ে যায় তবে নির্বাচন নামক শব্দটির অর্থ পাল্টে যাবে। গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা রচিত হবে। অন্য দিকে পশ্চিমা দেশগুলোর গণতন্ত্রের বুলি বেলুনের মতো উড়ে যাবে এবং অনাগত দিনে তারা আওয়ামী সম্পর্কে কোনো কথা বলতে গিয়ে এক শ’ বার চিন্তাভাবনা করে তার পর বলবে। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও ভুটানের রাষ্ট্রদূতের অবস্থা সমপর্যায়ের হবে এবং নির্বাচনের পর রাষ্ট্রদূতদের চলাফেরা ও কথাবার্তা সরকারের মেজাজ-মর্জি মতো চলবে। সরকারের বন্ধুরাষ্ট্রের নাগরিকরা আমাদের দেশ সম্পর্কে তাদের মহব্বত এবং আত্মীয়তার বন্ধন বাড়িয়ে দেবেন এবং তাদের ঘনঘন বাংলাদেশে আগমনের ফলে দেশের পর্যটন শিল্পের সীমাহীন উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের দেশের লোকজনকে ভালোভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে বন্ধুদের আদর-আপ্যায়নে নিয়োগ করা হবে এবং তাদের মনোরঞ্জনের সব ক্রীড়া কৌশল দেশের আনাচে-কানাচে সহজলভ্য করা হবে।
উল্লিখিত অবস্থায় ডামি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হর্তাকর্তার রাগ গিয়ে পড়েছে বেচারা তারেক রহমানের ওপর। কেন তিনি ডামি নির্বাচনে অংশ নিলেন না। কেন তিনি ২০১৮ সালের মতো বলির পাঁঠা হলেন না- এসব নিয়ে তারা যতই চিন্তাভাবনা করছেন ততই তাদের মেজাজে আগুন ধরে যাচ্ছে। অন্য দিকে ডামি নির্বাচনী উৎসবের আনন্দ বৃদ্ধির জন্য যেসব ছং ভং কেনা হয়েছিল তারা কোনো কাজে তো আসেইনি বরং উল্টো গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ারূপে পুরো ডামি মঞ্চকে কলঙ্কিত করে তুলছে এবং ডামি দর্শকদেরকে উপর্যুপরি হতাশার সাগরে ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলার আনাচে-কানাচে ঐতিহাসিক স্বৈরাচারবিরোধী জমানার মতো নানারকম গানের প্যারোডি তৈরি হয়ে গেছে এবং আধুনিক জামানার ব্যঙ্গাত্মক টিকটকে ডামির ইজ্জতহানির ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে।
ডামি নিয়ে আমি আর মামীরা যতই আনন্দ-ফুর্তির অভিনয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন পাবলিক ততই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। পিটার হাস কেন দিল্লি গেলেন। দেশে আর কোনো দিন এক-এগারো আসবে না এবং ভারত এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটতে দেবে না বা সমর্থন দেবে না এমন কথা বলে ওবায়দুল কাদের যাই বোঝাতে চান না কেন, জনগণ কিন্তু আসল ঘটনা বুঝে যাচ্ছে এবং লেন্দুপ দর্জির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে খিস্তিখেউর চালিয়ে যাচ্ছে। ভোটের মাঠে আমরা আর মামুরার নির্বাচন থিওরি ক্রমেই দঙ্গল রূপ নিচ্ছে এবং একই দলের নেতাকর্মীরা একই সূত্রে তিনটি কাজ করতে গিয়ে সব কিছু জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলছে।
প্রথমত, তারা বিএনপি-জামায়াতকে আগের মতোই তাড়া করে ফিরছে এবং অসহায় পঙ্গু-বিধবাদেরকে হুমকি দিচ্ছে তাদের কথামতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য; অন্যথায় সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা আর মামুরা নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ মারামারিতে সাধারণ জনগণকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণ আরো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ডামি ভোটের বিষয়ে বেশিমাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছে বিবদমান পক্ষের যারা জয়ী হবে তারা পরাজিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদেরকে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ওপর সাধারণ যে জুলুম-নির্যাতন করা হয় সেই একই কায়দায় নির্যাতন করবে। ফলে ভোটাররা আমরা আর মামুরা উভয় দলের শাখা-প্রশাখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
তৃতীয়ত, তাঁবেদার সরকারি কর্মচারীরা এবার ভারী বিপদে পড়েছেন। তারা এক দিকে বিএনপি-জামায়াতের ওপর চলমান মামলা-মোকদ্দমা, কোর্টে হাজিরা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি, আসামি খোঁজার নামে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং নতুন নতুন গায়েবি মামলার ফন্দিফিকিরের পাশাপাশি নির্বাচনের উল্লিখিত ভাবধারার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ; যদিও আমরা সবাই সেই প্রতিবেদনের একটি ডামি সংস্করণ পেয়ে গেছি চলতি বছর ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে। ফলে ১৮ ডিসেম্বর থেকে নৌকা-ডামি নৌকা-স্বতন্ত্র নৌকা-বিদ্রোহী নৌকার পাশাপাশি ঈগল ও ট্রাক নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। মাটির গাছে লাউ ধরেছে কিংবা ঢাকাই সিমেনার নায়ক-নায়িকার মার্কা কী এবং সেই মার্কার কোথায় ও কিভাবে সিল মারা হবে, তা নিয়ে তৈরি করা টিকটক ভিডিওর যন্ত্রণায় মানুষের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবার ভীষণ জিদ ধরেছেন ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম করে হলেও ৫০ শতাংশের বেশি ঘটানোর জন্য। অন্য দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জিদও কোনো অংশে কম নয়। তিনি ভোটকেন্দ্রে যেন ভোটার না আসে এবং আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচন যেন জনগণ বর্জন করে, সে জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। পাক-ভারতে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ ও পাকিস্তান জমানায় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক শাসকশ্রেণীর মধ্যে প্রথম দিকে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে উভয় অসহযোগ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। কাজেই ২০২৩ সালে এসে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বিএনপির প্রধান ব্যক্তি এখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তখন তারেক বিরোধীরা বলার চেষ্টা করছেন, উনি কি মহাত্মা গান্ধী অথবা বঙ্গবন্ধুর মতো হতে চান; না কি তাদের চেয়েও বড় কিছু!
যারা ডামি নির্বাচনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা এরই মধ্যে কতগুলো নজিরবিহীন সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছেন। এসব সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আওয়ামী লীগের নৌকা বনাম ডামি বনাম স্বতন্ত্র বনাম বিদ্রোহী বনাম গৃহপালিত তাঁবেদার গোষ্ঠীর মধ্যে নিদারুণ এক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত শুরু হয়ে গেছে। তারা প্রকাশ্যে সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে মাইকে গালিগালাজ করছেন। একে অপরের ব্যক্তিগত গোপন কর্ম, চুরি-চামারির অভিযোগ ইত্যাদি নিয়ে খিস্তিখেউর করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, সুযোগ পেলে মারামারি, কাটাকাটি শুরু করে দিচ্ছেন। বিভেদ বিসম্বাদকারীরা যেহেতু একই দলের, তাই বিএনপি-জামায়াত পেটানো বাহিনী এবার ভারী বিপদে পড়েছে। তারা নৌকার গলুই, নৌকার পাল, ছই, পাটাতন প্রভৃতিতে লাঠিচার্জ ও নৌকার মাঝির দলকে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে পারছে না। আর মামলা-হামলা-গুম-গুলির মতো পিলে চমকানো হাতিয়ারগুলোও ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে ডামি নির্বাচনের মান্যবর সদস্যকুলের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী হামলা হররোজ জ্যামিতিকহারে বেড়েই চলেছে।
ডামি নির্বাচনের মামা-ভাগিনাদের টানাটানির কবলে পড়ে চ্যাপটা হয়ে যাচ্ছে। আমির প্রার্থীরা যেভাবে ওসি-ডিসিদেরকে গালি দিচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ডামি ও মামীর প্রার্থীরা গালাগালির পাশাপাশি বদলি বরখাস্তের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দিচ্ছে। ফলে রাতের ভোটের কারিগরদের সেই সুনাম-সুখ্যাতি হাল আমলে নিদারুণ হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে।
উল্লিখিত অবস্থা যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তবে ডামি নির্বাচন ৬ জানুয়ারির আগেই দফারফার কবলে পড়বে। আর কোনো কারণে যদি ৬ জানুয়ারির মধ্যে দফারফা না হয় তবে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা এমন হবে, যা দেখে কেউ যদি তারেক রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের সফলতার গীত গেয়ে তাকে আধুনিককালের গান্ধী উপাধি দিয়ে বসেন, তবে তার জন্য প্লিজ, আমাকে কিন্তু দায়ী করে বসবেন না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য