মানসিক খাদ্যের ব্যাপারে এত উদাসীনতা কেন -ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

অনেক দিন আগের কথা। এক লোক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। পরিচিত একজন জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি স্মিত হেসে বললেন, তা তো জানি না। তখন সেই ব্যক্তি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তাহলে কে জানেন? তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আমার ঘোড়া জানে!

বহুদিন আগে ড্যারেন হার্ডির লেখা ‘দ্য কম্পাউন্ড ইফেক্ট’ বইতে ঘটনাটি পড়েছিলাম। আজকাল কেন যেন চারপাশে এমন অসংখ্য ঘোড়সওয়ারকে প্রতিনিয়ত দেখছি। তারা অবিরত ছুটে চলেছেন। কিন্তু ঠিক কোথায় যাচ্ছেন, কেনইবা যাচ্ছেন তা নিজেরাও জানেন না। হয়তো সেটা জানে তাদের স্মার্টফোন!

বহু লোক প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন গেমস, ভিডিও শেয়ারিং সাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ করছেন। কিন্তু তার শেষটা কোথায়, সেটা তারা নিজেরাও জানেন না। এমনকি কেনইবা তারা সেখানে জীবনের এত মূল্যবান সময়, মনোযোগ ও শক্তির অপচয় করছেন তারও সন্তোষজনক জবাব নেই। অথচ তারা সেটা নিত্যদিন করছেন। অন্যান্য কাজে ফাঁকি দিয়ে হলেও সেটা অব্যাহত রেখেছেন।

ঈদের ছুটিতে দীর্ঘ পথ জার্নি, পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুদের আড্ডা সব জায়গায় কেন যেন গল্পে বর্ণিত ওই ঘোড়ার দাপট প্রবলভাবে লক্ষ করছিলাম। আগে ভ্রমণের সময় কিছু মানুষকে বই বা সংবাদপত্র পড়তে দেখা যেত। সেটা যারা করত না তারা পাশের জনের সঙ্গে গল্প করত। আমার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ট্রেন ও বাস জার্নির সময় পাশের সিটে বসা ব্যক্তির সঙ্গে আলাপের সূত্র ধরে অনেক উপকার ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ পেয়েছি।

অথচ এখন অনেকেই চলার পথে পাশের সিটে বসা মানুষটার দিকে ঠিকমতো তাকায় না। অন্যজন কথা শুরু করলেও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটার শঙ্কায় তারা হ্যাঁ-না বলে শেষ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে বিরক্তি প্রকাশ করেন। ফলে তাদের সত্যিকারের নেটওয়ার্ক বড় হয় না।

মানুষ ‘সামাজিক’ হওয়ার অজুহাতে কেন যেন নিজেদের গড়া ক্ষুদ্রতম বৃত্তে আটকে যাচ্ছে। সেখান থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করছে না। ভাবছে সেই বিদ্যমান নেটওয়ার্ককে সন্তুষ্ট রাখাই তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান বা সাধনা!

কিছুদিন আগে এক বহুজাতিক কোম্পানির এক বড় কর্তা বিশেষ প্রয়োজনে আমাদের অফিসে এলেন। তিনি অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে আলাপ করলেন। অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ধরনটি ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। কিন্তু সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আসা জুনিয়রটি সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল তার তথাকথিত ‘সামাজিক যোগাযোগ’ রক্ষায়!

বিদায়ের আগে জুনিয়রের উদ্দেশে হেসে বললাম, শুধু বিদ্যমান নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করায় মনোযোগ দিলে চলবে? এটা সম্প্রসারণ করতে হবে না? আপনার বস একদিন এমনি এক সিনিয়রের সঙ্গে ঘুরতে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এখন এ প্রতিষ্ঠানের অনেকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। অথচ এ পুরো সময়ে আপনি কারো সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথাও বললেন না, নিজেকে মেলে ধরতে ন্যূনতম চেষ্টা করলেন না। পরে কখনো আপনি একা এলে হয়তো আমরা আপনাকে চিনতেই পারব না!

তাছাড়া কোথাও কয়েকজন ব্যক্তি সমবেত হলে তাদের প্রতি ‘মনোযোগ’ দেয়া ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। নিজে কিছু না বললেও অন্যদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিত। পারিবারিক আলোচনা, বিভিন্ন ধরনের সভা, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে শারীরিকভাবে অংশ নিয়ে শুধু নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়। এ বোধটা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা এমন অনুষ্ঠানে প্রায় সবাই স্ক্রিনে ব্যস্ত হয়ে উঠবে—সেটাই যেন স্বাভাবিক রীতি বলে গণ্য হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে নগরীর এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে গেলাম। স্বভাবতই বেশকিছু সময় বসতে হলো। তখন চারপাশের টেবিলগুলোয় উপস্থিত ব্যক্তিদের তথাকথিত স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি সত্যিই আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমরা অন্যান্য আসক্তি নিয়ে কথা বললেও এ ব্যাপারটা কেন যেন এখনো ‘ইনোসেন্ট’ পর্যায়ে রয়ে গেছে।

এক টেবিলে বসা আটজনের সবাই ছবি তোলা এবং সেগুলো শেয়ার করায় ব্যস্ত ছিল। কেউ কারো দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলছিল না। অনেকে এক হাতে চামচ দিয়ে খাবার মুখে তুলছে আর অন্য হাত দিয়ে ফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করছে! আগে এমন জনসমাগমে ‘আড্ডা’ ছিল প্রাণ। সবাই মন খুলে কথা বলত। অন্যেরা তাতে সঙ্গ দিত। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় তাদের আচরণে এর বিন্দুমাত্র চেষ্টা দেখলাম না।

সদ্যবিবাহিত দম্পতি, প্রেমিক জুটি, কোলের বাচ্চার মা-বাবা, শিশু-কিশোরদের সবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ ফোন স্ক্রিনে। এমনকি পুরোদস্তুর পর্দা করা কিশোরীও প্রতিটি খাবারের সঙ্গে সেলফি তুলছিল! এক গ্রুপের সঙ্গে সম্ভবত ওই পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি খুব অসহায়ভাবে চারপাশটা দেখছিলেন।

ভালোভাবে লক্ষ করলাম, সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু তার ও আমার হাতে ফোন নেই! বাকি সবাই ফোনে কিছু না কিছু করছে। এমনকি ওয়েটারদের কেউ কেউ সুযোগ পেলেই রেস্টুরেন্টের এক চিপায় গিয়ে তাদের নোটিফিকেশনগুলো দেখছে আর একা একাই হেসে উঠছে।

রেস্টুরেন্টে বসা ছিলাম বলেই হয়তো ‘ডায়েট’ শব্দটা মাথায় এল। সুস্বাস্থ্যের আশায় আজকাল প্রায় সব বয়সীদের মধ্যে ডায়েট করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তাছাড়া বাস্তব কারণেই আমরা সব ধরনের খাবার খাই না। ভোজ অনুষ্ঠানে ব্যাপক আয়োজন থাকলেও সিলেক্টিভ কিছু আইটেম দিয়ে খাওয়া শেষ করতে সচেষ্ট থাকি। তাহলে তথাকথিত ‘বিনোদন’ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে কেন তেমনটা হবে না?

এক্ষেত্রে এক বড় ভাইয়ের কাছে শোনা তার জীবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ আয়োজনের এক ডিনারের কথা মনে পড়ছে। অনেক দিন আগে তিনি অতি ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির সঙ্গে প্রত্যন্ত এক গ্রামে বিশেষ এক কাজে যান। স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তির বাড়িতে রাতের খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত পূর্বনির্ধারিত ছিল। ফলে সেই গৃহকর্তা তার সাধ্যের মধ্যে আয়োজনের কোনো ত্রুটি করেননি। সেই বড় ভাইয়ের ভাষ্যমতে, অতিথির সঙ্গে ডাইনিং হলে ঢুকে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া!

তারা দুজন খেতে বসে জানলেন, মাত্র ৬০ পদের রান্না হয়েছে! অতিথি তির্যক হাসি হেসে গৃহকর্তাকে বললেন, আমাকে কি আপনার রাক্ষস মনে হয়? কৌতূহল সামলাতে না পেরে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, অতিথি মোট কত পদ ছুঁয়ে দেখেছিলেন বলে আপনার মনে হয়? তিনি বললেন, সর্বোচ্চ পাঁচ-ছয় পদ হবে।

প্রিয় পাঠক, আপনি হলে কী করতেন? সবই একটু একটু করে চেখে দেখতেন? কিন্তু তা কি সত্যিই করা সম্ভব হতো? আর সেটা করলেও খানা শেষে পরিতৃপ্ত থাকতেন?

না, সেটা হতো না। আর সে কারণেই বিপুল আয়োজনের পানাহারে আমরা অনেক বেশি সিলেক্টিভ হই। বহু আইটেম অতি সুস্বাদু হওয়ার পরও সেগুলো গণহারে গলাধঃকরণ করি না। কারণ আমরা জানি তাতে তৃপ্তির চেয়ে অস্বস্তির মাত্রা বাড়ে।

এখন কথা হলো—শরীরের খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা এত সংযত। অনেকে দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে কিছুই খান না। তাহলে নিত্যদিনের বিনোদন উপকরণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও কি তেমনটা হওয়া উচিত নয়?

টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব ও অন্যান্য সাইট আমাদের সামনে যত উপাদেয় খাবারই হাজির করুক না কেন, আমাদের কি সংযত হওয়া উচিত নয়? তারা দিতেই থাকবে আর আমরা গোগ্রাসে সেগুলো গিলতেই থাকব, তা কি হওয়া উচিত?

খাওয়া, ঘুম, খেলাধুলা সবক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে আমরা সে প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিই। অর্থাৎ সুযোগ থাকলেও একটা মাত্রার বেশি সেগুলোয় যুক্ত থাকি না। তাহলে শুধু মোবাইল ফোনের ‘কনটেন্টে’র ক্ষেত্রে আমরা কেন দিবারাত্রি সেগুলো নিয়ে পড়ে থাকছি?

আজকাল শরীরের সুস্থতার জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নানা ধরনের খাদ্য তালিকা করছে। সে মোতাবেক খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করছে। তাহলে মানসিক খাদ্যের ব্যাপারে এত উদাসীনতা কেন?

সারা দিন আমরা বিনোদনের নামে যা যা গ্রহণ করি তার কত ভাগ সত্যিকারের উপাদেয় বা সুন্দর মানসিকতার জন্য দরকারি? সেগুলো বাদ দিয়ে কনটেন্ট প্রোভাইডারদের খেয়ালখুশিমতো যা সামনে আসবে তাই গিলতে থাকা দীর্ঘমেয়াদে কি সত্যিই কল্যাণকর হওয়া সম্ভব?

আমাদের মেন্টাল হেলথের জন্য কি ডায়েটের ব্যাপারে এখনই তত্পর হওয়া উচিত নয়? আশা করি বিষয়টা ভেবে দেখবেন।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ’ বইয়ের লেখক।

উৎস : বণিকবার্তা, ২৬ জুলাই ২০২২।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *