রিলে রেসের জীবন ! ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

বিটিভিতে ‘হীরামন’ নামে এক আলেখ্যানুষ্ঠান হতো। রাজা-বাদশাদের কাহিনীনির্ভর সে অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল। একেক দিন একেক ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে পর্বগুলো সাজানো হতো। তখন থেকেই রাজা-বাদশাদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ জন্মায়।

কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়াকালে একবার আমাদের পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উত্তরা গণভবন ও দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে। স্বভাবজাত ঔৎসুক্য থেকে নাটোরের রাজার নানা কাহিনী জানতে চেষ্টা করি। সেই কিশোর বয়সেই বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়েছিল।

ভাই রঘুনন্দনের সহায়তায় নাটোর রাজ (১৭০৬ সালে) প্রতিষ্ঠা করেন রামজীবন। প্রায় দুই যুগ তিনি রাজত্ব করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে উত্তরাধিকার প্রশ্নে ছিলেন উদ্বিগ্ন। এক পর্যায়ে রামকান্ত নামক এক শিশুকে দত্তক নেন। অর্থাৎ অতি সাধারণ ঘরে জন্মগ্রহণ করেও রামকান্ত আকস্মিক হয়ে ওঠেন ‘রাজপুত্র’!

যদিও রাজকার্যে তার উদাসীনতায় বাবা রামজীবন ছিলেন চিন্তিত। ফলে এমন এক পুত্রবধূ আনতে চাইলেন যিনি রাজপরিবারের হাল ধরতে পারবেন। সেই আলোকেই বগুড়ার ছাতিয়ান কাছারি বাড়িসংলগ্ন সাধারণ পরিবারের কন্যা রাণী ভবানীকে তিনি পুত্রবধূ করার সিদ্ধান্ত নেন।

রামকান্তের স্বল্প শাসনকালের অবসান ঘটে তার আকস্মিক মৃত্যুতে। তখন (১৭৪৮ সালে) নবাব আলীবর্দী খান রাণী ভবানীর ওপর শাসনভার অর্পণ করেন। অর্থাৎ এখন থেকে ২৭৫ বছর আগে অন্দরমহলের এক বধূ পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারতবর্ষের অন্যতম জমিদারির হাল ধরেন!

ঘটনাক্রমে তার দুই পুত্র অকালে প্রয়াত হন। ফলে রাজপরিবারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে একমাত্র কন্যা তারাকে বিবাহ দেন রঘুনাথ লহরীর সঙ্গে। ভাগ্যের কী পরিহাস! সেই জামাইও স্বল্প বয়সে মারা যান।

উত্তরাধিকার প্রশ্নের সমাধানকল্পে তিনিও এক কিশোরকে দত্তক নেন! প্রায় ৫৩ বছরের সফল শাসনের অবসান ঘটে ‘অর্ধ বঙ্গেশ্বরী’খ্যাত রাণী ভবানীর মৃত্যুর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে সেই দত্তক সন্তান রামকৃষ্ণ রায় নাটোরের রাজা হন।

পরের ঘটনাপ্রবাহ জানলেও সেটা বলে আর আপনাদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না। কারণ আজকের আলোচ্য বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছার জন্য এটুকু জানাই যথেষ্ট।

প্রিয় পাঠক, উক্ত বর্ণনার চরিত্রগুলো মনোযোগসহ লক্ষ করুন। আপনার-আমার মতো সাধারণ কোনো পরিবার বা সামান্য সম্পদের উত্তরাধিকার প্রশ্ন নয়। বরং একটি রাজপরিবারের হাল ধরার ঘটনা কত আঙ্গিকে বদলে গেছে।

ভাইয়ের বদৌলতে রামজীবন, দত্তকসূত্রে রামকান্ত ও রামকৃষ্ণ, বৈবাহিকসূত্রে রঘুনাথ ও রাণী ভবানীর জীবনের মোড় কতটা নাটকীয়ভাবে ঘুরে যায়, তাই না? আবার রঘুনাথের জীবনে রাজা হওয়ার সুযোগ এলেও অকালমৃত্যু তাতে বাধ সাধে… মানবজীবনের রঙ্গমঞ্চে উত্থান-পতন সত্যিই কল্পনাতীত।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা ব্যস্ততায় দম ফেলার সুযোগ পাই না। একের পর এক পরিকল্পনা, সেগুলোর বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ, নানা পক্ষকে ম্যানেজ, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত একাকার করে ফেলছি।

একটু স্থির হয়ে বসা, তৃপ্তিসহকারে খাওয়া কিংবা ঘুমানোর সময় পাচ্ছি না। একক উৎসের আয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না। ক্রমাগত দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি! কিন্তু একবার ভাবুন তো এর শেষ কোথায়?

আকস্মিক ভূমিকম্প, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, গার্ডার ভেঙে পড়া, সড়ক দুর্ঘটনা, ভবনে বিস্ফোরণ, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো যেকোনো ঘটনার মাধ্যমেই সেটা হতে পারে। যদি সেটা নাও হয়, স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে তবুও ঠিক কতদিন এমন দৌড় চলবে?

বড় জোর ২০ বা ৪০ বছর, তাই না? তারপর আপনার এ ‘বিশাল সাম্রাজ্যে’র পরিণতি কী হবে? রাজা রামজীবন বা রাণী ভবানীর কথা একবার ভাবুন। আজ কোথায় তাদের উত্তরাধিকার? কে ভোগ করছে তাদের বিপুল সম্পদ?

আসলে আমরা কেউ জানি না শেষটা কীভাবে হবে। আমাদের এত কষ্টে অর্জিত সম্পদ প্রকৃতপক্ষে কারা ভোগ করবে? ভাবছেন আপনার স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের সদস্যরা। কেন, তারা আপনার আগে অথবা একইসঙ্গে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না তার নিশ্চয়তা কি এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন?

তাছাড়া তারা থাকলেই কী? রেখে যাওয়া সম্পদের ঠিক কতটা মৃত্যুর পর আপনার কল্যাণে ব্যয় হবে? আপনার বাবা-দাদা-নানার সম্পদের বর্তমান চিত্র থেকে হিসাবটা একবার মেলাতে চেষ্টা করুন না।

মহাকালের তুলনায় অতি সামান্য সময়ের জন্য আমরা এ পৃথিবীতে বিচরণের সুযোগ পেয়েছি। তার আবার বড় একটা অংশ থাকতে হয় পরনির্ভরশীল। আরেক অংশ ঘুমিয়ে কাটাই। অপচয়ের অংশটাও কম নয়।

বাকি সময়টুকু ছুটতে থাকি অসম্ভব সব অর্জনের পেছনে। কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি অর্জন হলেই কী জীবন ধন্য হয়? আমরা কি সচেতনভাবে নিজেদের জীবনে ফুলস্টপ দিতে পারি?

সব লক্ষ্য সুন্দরভাবে অর্জনের পর মৃত্যুর জন্য কি নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারি? যে অবস্থায় মৃত্যুর ফেরেশতাকে বলতে পারব—হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মি. আজরাঈল!

না, তেমনটা হয় না। অন্তত আমার পরিচিত কারো ক্ষেত্রে তেমনটা হতে দেখিনি। বরং সবাই অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে যায়। কারণ ক্ষুদ্র এ জীবনে আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে চাই। আমাদের মেধা, রূপ, সৌন্দর্য, ক্ষমতা, প্রভাব দিয়ে ‘অনেক কিছু’ নিজেদের দখলে নিতে সচেষ্ট থাকি। কিন্তু যার কোনো শেষ নেই তার জন্য এমন মরিয়া হওয়া সত্যিই কি তেমন অর্থ বহন করে?

প্রকৃতপক্ষে মানবধারায় আমাদের ভূমিকা কী? জাস্ট রিলে রেসের বাটনটা একজনের (পূর্ববর্তী প্রজন্মের) কাছ থেকে নিয়ে আরেকজনের (পরবর্তী প্রজন্মের) হাতে তুলে দেয়ার চেয়ে কি বেশি কিছু?

এখন প্রশ্ন হলো, রাজা রামজীবন বা রাণী ভবানীর মতো যদি সেই বাটনটা নেয়ার মতো কেউ না থাকে? তবুও কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষে এ স্থান আমাদের ছাড়তে হবে। মৃত্যুর ক্ষণ হাজির হলে এক সেকেন্ডও এদিক সেদিক হবে না। আমাদের ড্রিম প্রজেক্ট শেষ হওয়া কিংবা প্রিয়জনদের কাছে বিদায় নেয়ার সময়টুকুও মঞ্জুর করা হবে না।

তাহলে ঠিক কী জন্য ন্যায়-অন্যায়, নীতি-নৈতিকতা ভুলে এমন সম্পদের পাহাড় গড়ার চেষ্টা? এ অর্জনের জন্য ব্যক্তি আপনার বা আমার জীবনে যে ত্যাগ সমগ্র জীবনে তার কতটুকু ভোগ করতে পারি?

বলতে পারেন, তাহলে কি আমি ধন-সম্পদ অর্জন বা সফলতার চেষ্টার বিপক্ষে? না, অবশ্যই না। বরং সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে অকল্পনীয় মেধা ও ক্ষমতা দিয়েছেন তার সদ্ব্যবহারে সর্বোচ্চ তৎপর থাকা উচিত। মানুষের এমন চেষ্টাই দুনিয়াকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে।

কিন্তু ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য ক্রেজি হওয়া, নিজের শরীর ও মনকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না দেয়া, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি উদাসীন থাকা, একের পর এক অরিরিক্ত চাপ নেয়া… খুব কি দরকার?

রিলে রেসের ক্ষেত্রে প্রথম দৌড়বিদ অনেকটা এগিয়ে থাকলে পরবর্তী জন তুলনামূলকভাবে রিল্যাক্সড থাকেন। আর প্রথমজন একটু পিছিয়ে থেকে তার হাতে বাটনটা হস্তান্তর করলে সে দৌড়ের গতি আরো বাড়ায়।

এভাবে এক প্রজন্ম অনেক বেশি পরিশ্রম করলে পরের প্রজন্ম আরামপ্রিয় ও বিলাসী হয়ে ওঠে। একই ছাদের নিচে বাস করা দাদা, বাবা ও নাতি তিনজনের জীবনযাপনের ধরন খেয়াল করলেই তা স্পষ্ট হবে।

তাছাড়া বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের অতি সফল ব্যবসায়ীদের লক্ষ করুন। দেখবেন তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কীভাবে শূন্য থেকে সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা কী বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।

অথচ তাদের সন্তানদের অনেকেরই জীবনযাপনের ধরন পুরোপুরি ভিন্ন। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার হাল ধরে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কেউবা হয়েছে ঋণের ভারে জর্জরিত। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে নানা কেলেঙ্কারিতে!

ফলে পরবর্তী বহু প্রজন্ম যেন কিচ্ছু না করে, শুয়ে-বসে বিলাসিতা করে জীবন কাটাতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ অর্জনের দায়িত্ব দিয়ে কেউ আমাদের দুনিয়ায় পাঠায়নি। তাছাড়া আপনি কেন ধরেই নিচ্ছেন যে তারা অপদার্থ ও অকর্মণ্য হবে? ফলে তাদের জন্য দরকারি সব সম্পদ আপনাকেই অর্জন করে যেতে হবে!

বরং বিষয়টাকে এভাবে ভাবা যায়— আপনি যে সুযোগ ও পরিস্থিতিতে এ পৃথিবীতে জন্মেছিলেন আপনার সন্তানরা তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। আপনার শৈশবের সীমাবদ্ধতাগুলো তাদের মোকাবেলা করতে হয়নি।

তাহলে রিলে রেসে এতটা এগিয়ে দেয়ার পরও যদি তারা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারে—তাদের পতন ঠেকাবেন কীভাবে? আর সেই সামর্থ্য কি সবসময় আপনার থাকবে? না, থাকবে না।

তাই তাদের জীবন নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। মেধা ও যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহারে তাদের আগ্রহী করে তুলুন। তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করুন। সেটা সম্পদ রেখে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই পদ্ধতি।

বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ বা সম্পদ মজুদ করে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাইলে সম্ভবত আপনি ভুল পথে হাঁটছেন। কারণ ওসব সম্পদ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হাতছাড়া হওয়া সম্ভব।

বিশ্বাস না হলে আপনার শৈশবে এলাকার ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবারকে খেয়াল করুন। হিসাব খুব সহজেই মিলে যাবে। পৈতৃক সম্পদ তাদের দুরবস্থা রোধ করতে পারেনি।

পরিশেষে এক ধাঁধা দিয়ে শেষ করি। মনে করুন আপনার জন্য বিকল্প দুটি পুরস্কার রয়েছে। প্রথমটি হলো এককালীন ১০ কোটি টাকা। অন্যটি হলো বিশেষ ধরনের ১ টাকার নোট যা প্রতিদিন দ্বিগুণ হয়। এভাবে এক মাস পর্যন্ত চলবে। আপনি কোন পুরস্কারটি নেবেন?

নিশ্চয়ই প্রথমটি, তাই তো? কিন্তু দ্বিতীয়টি একবার হিসাব করে দেখবেন। তার পরিমাণ হয় ৫৩ কোটি টাকারও বেশি!

তাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়তে ব্যস্ত না থেকে বরং তাদের সেগুলো অর্জনের কৌশল ও ব্যবস্থাপনা শেখাই। তাছাড়া শুধু নিজের সন্তান নয় বরং সমগ্র মানব সন্তানদের কল্যাণের কথাও ভাবা দরকার। তাতে আখেরে সবারই কল্যাণ।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১৪ মার্চ ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *